এক কথায় সাধারণ হাইড্রোজেন পরমাণুর বদলে হাইড্রোজেনের আরেকটি আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম দিয়ে পানির অণু গঠিত হলে তাকে ভারী পানি বলা হয়।
অক্সিজেনের একটি পরমাণুর সাথে দু’টি হাইড্রোজেন পরমাণুর সমন্বয়ে পানির অণু তৈরি হয়। হাইড্রোজেনের কোন ধরণের পরমাণু দিয়ে পানি তৈরি হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিতে হাইড্রোজেনের তিন ধরনের পরমাণু বা আইসোটোপ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে:
- প্রোটিয়াম- কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে কেবল একটি প্রোটন থাকে, তেজস্ক্রিয় নয়, সংকেত 1H
- ডিউটেরিয়াম- কেন্দ্রে একটি প্রোটন এবং একটি নিউট্রন থাকে, তেজস্ক্রিয় নয়, সংকেত 2H বা D (একে ভারী হাইড্রোজেনও বলা হয়)
- ট্রিটিয়াম- কেন্দ্রে একটি প্রোটন এবং দু’টি নিউট্রন থাকে, তেজস্ক্রিয়, সংকেত 3H
প্রকৃতিতে পাওয়া হাইড্রোজেনের ৯৯.৯৮ ভাগই প্রোটিয়াম, তাই হাইড্রোজেন পরমাণু বলতে আমরা প্রোটিয়ামকেই বুঝি। অল্প পরিমাণে থাকা হাইড্রোজেনের অন্যান্য পরমাণুগুলোও পানির অণু তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
অনেক সময় দেখা যায় পানির অণুতে থাকা দু’টি হাইড্রোজেন পরমাণুর একটি কিংবা দু’টিই ডিউটেরিয়াম। এগুলোই ভারী পানির অণু। প্রতি ২০ মিলিয়ন পানির অণুতে একটি ভারী পানির অণু পাওয়া যায়।
বরফ পানিতে ভাসে, কিন্তু ভারী পানির বরফ কি পানিতে ভাসে?
না, ভারী পানির অণু ভারী হওয়ায় এর বরফও ভারী হয় তাই সাধারণ পানিতে ভারী পানির অণুতে তৈরি বরফ ডুবে যাবে। তবে তরল ভারী পানিতে ভারী পানির বরফ ভেসে থাকতে পারবে। ভারী পানির হাইড্রোজেন বন্ধন তুলনামূলকভাবে আঁটসাঁট হওয়ায় এর ঘনত্বও বেশি হয়।
ভারী পানি খুব বেশি ভারী নয়
পানির অণুর ভরের পেছনে অক্সিজেনের ভূমিকাই প্রধান। ভারী হাইড্রোজেন পরমাণু বা ডিউটেরিয়ামের কারণে পানির ঘনত্ব শতকরা ১১ ভাগের মত বৃদ্ধি পায়।
ডিউটেরিয়াম পরমাণু কি বড়?
না, পরমাণুর আকার নির্ধারিত হয় কক্ষপথের ইলেকট্রনের মাধ্যমে। হাইড্রোজেনের সব আইসোটোপের ইলেকট্রন সংখ্যা সমান তাই পরমাণুর আকারও একই রকম। কিন্তু কেন্দ্রে অতিরিক্ত নিউক্লিয়াস থাকায় এটি ভারী হয়।
ভারী পানি কি তেজস্ক্রিয়?
ডিউটেরিয়াম আইসোটোপ তেজস্ক্রিয় নয়, তাই সাধারণ পানির মত ভারী পানিও তেজস্ক্রিয় নয়। মোটের ওপর এটি সাধারণ পানির মতই।
ভারী পানির সংকেত
সাধারণ পানির সংকেত H2O, ভারী পানির সংকেত কেমন হবে তা নির্ভর করছে কি কি আইসোটোপ দিয়ে পানির অণু গঠিত হয়েছে তার ওপর।
- সাধারণ পানি বা প্রোটিয়াম আইসোটোপে গঠিত পানির অণুর সংকেত H2O বা 1H2O
- ডিউটেরিয়াম আইসোটোপে গঠিত পানির অণুর সংকেত D2O বা 2H2O
- একটি ডিউটেরিয়াম এবং একটি প্রোটিয়াম আইসোটোপে গঠিত পানির অণুর সংকেত DHO
- দু’টি ট্রিটিয়াম আইসোটোপে গঠিত পানির অণুর সংকেত T2O বা 3H2O
- একটি টিট্রিয়াম একটি প্রোটিয়াম THO
- একটি টিট্রিয়াম একটি ডিউটেরিয়াম TDO
ভারী পানি নিয়ে এত কথা কেন?
শিল্পে ভারী পানির বিভিন্ন ব্যবহার থাকলেও সবচেয়ে বেশি কথা হয় পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার প্রসঙ্গে।
পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে প্রয়োজন হয় ইউরেনিয়াম। প্রকৃতিতে পাওয়া ইউরেনিয়ামের প্রায় পুরোটাই ইউরেনিয়াম ২৩৮ আইসোটোপ। মাত্র ০.৭ ভাগের মত ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটোপ থাকে। পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটোপ প্রয়োজন হয়। খনি থেকে পাওয়া ইউরেনিয়ামে ২৩৫ আইসোটোপের ঘনমাত্রা বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এজন্য প্রয়োজন হয় সেন্ট্রিফিউজ নামে এক প্রকার যন্ত্র।
তবে ভারী পানি ব্যবহার করে নিউট্রনের গতিকে মন্থর করে দিতে পারলে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামকেই পারমাণবিক চুল্লীর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ থেকে উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে বেশি পরিমাণে প্লুটোনিয়াম তৈরি হয় যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। তাই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো অন্যদের ভারী পানি তৈরি এবং মজুদের খবরে সবসময় উদ্বেগ প্রকাশ করে।