এটি এক ধরনের শক্তিশালী বিস্ফোরক রাসায়নিক। গ্লিসারিল ট্রাই নাইট্রেট হিসেবেও পরিচিত। রকেটের জ্বালানি, এমনকি হৃদরোগের ওষুধ হিসেবেও নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্লিসারিন, ঘন সালফিউরিক এসিড এবং নাইট্রিক এসিডের বিক্রিয়ায় এটি তৈরি হয়।
১৮৪৬ সালে রাসায়নিকটি আবিষ্কৃত হলেও এর ব্যবহার আয়ত্ত করতে বেশ সময় লেগে যায়। সামান্য ঝাঁকুনিতেই নাইট্রোগ্লিসারিন বিস্ফোরিত হতে পারে। ফলে এটি পরিবহন করাও বেশ বিপদজনক। আলফ্রেড নোবেলের আগে কেউ এটি বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করতে পারেননি। তিনি কাঠের গুঁড়ো এবং কাঠকয়লার গুঁড়োর মত সচ্ছিদ্র পদার্থে নাইট্রোগ্লিসারিন ঢেলে বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করেন। আরও পরে তিনি নানা ধরনের জৈব পদার্থ ব্যবহার করেন।
নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা অত্যন্ত বিপদজনক। ১৮৬৪ সালে এক বিস্ফোরণে নিজের ভাইসহ পাঁচজনকে হারান আলফ্রেড নোবেল। তবু দমে না গিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। নিরাপত্তার জন্য একটি লেকের ভেতর ভাসমান বার্জে কাজ করতেন তিনি। এসব গবেষণাই তাকে ডিনামাইট তৈরির পথে নিয়ে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক তৈরির কারখানা স্থাপন করেন তিনি। নিজের অন্যান্য আবিষ্কারও তাকে প্রচুর অর্থ এনে দেয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অর্থ আর পরিচিতি এনে দেয় বিস্ফোরক ব্যবসা।
নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের পেছনে মজার ঘটনা- “মৃত্যুর সওদাগর মারা গেছেন”
এটি তার দুর্নামেরও কারণ হয়ে ওঠে। একটি মজার ঘটনা তাঁর মধ্যে এ উপলব্ধি তৈরি করে। ১৮৮৮ সালে ফ্রান্সে অবস্থানরত তাঁর এক ভাই মারা গেলে সেখানকার পত্রপত্রিকা ভাইয়ের সাথে আলফ্রেড নোবেলকে গুলিয়ে ফেলে এবং শিরোনাম করে, “মৃত্যুর সওদাগর মারা গেছেন”। তখনই আলফ্রেড নোবেল বুঝতে পারেন কিভাবে ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা হতে চলেছে। আর তাই প্রবর্তন করেন নোবেল পুরস্কার। যা তাঁকে আজও সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত রেখেছে। তবে আলফ্রেড নোবেল নিজেও যে বিদ্যানুরাগী ছিলেন না তা নয়।
নাইট্রোগ্লিসারিনের রাসায়নিক সংকেত C3H5(NO3)3 । ভারী ও তৈলাক্ত এ রাসায়নিকটি বর্ণহীন কিংবা হালকা হলুদ রঙের হয়ে থাকে। আপেক্ষিক গুরুত্ব (specific gravity) ১.৬০ । নাইট্রোগ্লিসারিনের দু’ধরনের স্ফটিক রয়েছে; একটির গলনাঙ্ক 2.8° C (37 °F) আর অন্যটির গলনাঙ্ক 13.5° (56.3° F) ।
কেন নাইট্রোগ্লিসারিন এত শক্তিশালী এবং বিপদজনক?
নাইট্রোগ্লিসারিন অণু স্থিতিশীল নয়। সামান্য উত্তেজনাতেই নাইট্রোগ্লিসারিন অণু ভেঙে নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, পানি ও অক্সিজেন তৈরি হয় যা অনেক বেশি স্থিতিশীল। বিক্রিয়াটি নিম্নরূপ:
4C3H5(ONO2)3 (l) → 6N2 (g) + 12CO2 (g) + 10H20 (g) + O2 (g)
নাইট্রোগ্লিসারিনের বিপুল বিস্ফোরণ ক্ষমতার কারণ এই বিক্রিয়াটির মধ্যে লুকিয়ে আছে। উৎপাদ বা বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট সবগুলো পদার্থই গ্যাসীয়। বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট পদার্থের আয়তন আদি আয়তনের ১,২০০ গুণ। অর্থাৎ ১ ঘন সেন্টিমিটার আয়তনের নাইট্রোগ্লিসারিন বিস্ফোরিত হয়ে ১,২০০ ঘন সেন্টিমিটার আয়তনের গ্যাসীয় পদার্থ তৈরি করবে। আর বিক্রিয়াটি নিমিষেই ঘটে যায়। ভেবে দেখুন হাতের মুঠোয় থাকা সামান্য একটু রাসায়নিক মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরিত হয়ে ১,২০০ গুণ আয়তন দখল করলে কি পরিস্থিতি হবে? তাৎক্ষণিক ভাবে প্রচণ্ড ধাক্কা সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে সংশ্লিষ্ট স্থানের চাপ ২০,০০০ বায়ুচাপ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
শুধু চাপই তৈরি হয় না। বিস্ফোরণের ফলে প্রচুর তাপও উৎপন্ন হয় যার ফলে তাপমাত্রা ৫,০০০° সেলসিয়াস (৯,০০০° ফারেনহাইট) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
এসব বিবেচনায় নাইট্রোগ্লিসারিন গান পাউডারের চেয়েও শক্তিশালী। ভর বিবেচনায় এটি গান পাউডারের চেয়ে ৮ গুণ শক্তিশালী এবং আয়তন বিবেচনায় এটি গান পাউডারের চেয়ে ১৩ গুণ শক্তিশালী।
হৃদরোগের চিকিৎসায়ও নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহৃত হয়। হৃদপিণ্ডের রক্তনালীতে চর্বি জমে রক্তনালী সরু হয়ে হয়ে গেলে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। এসব ক্ষেত্রে স্প্রে হিসেবে কিংবা মুখে খাওয়ার ওষুধ হিসেবে নাইট্রোগ্লিসারিন দেয়া হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে এত বিপদজনক একটি রাসায়নিক কি করে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ান হৃদরোগীরা? উত্তরটা সহজ। এখানে অত্যন্ত লঘু (১%) দ্রবণ ব্যবহার করা হয়।