কেউ হয়ত তেলাপোকা কিংবা মাকড়সা দেখে ভয় পান। ঘরের এক কোণে এগুলো দেখলে তিনি হয়ত লাফিয়ে চেয়ারে উঠে পড়বেন। আবার অনেকের মধ্যে উচ্চতা-ভীতি এতটাই প্রবল যে রোলারকোস্টারে ওঠার কথা ভাবতেই পারেন না। কিন্তু ভয়ের অনুভূতি খুব প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। বিবর্তনের ধারায় তৈরি হওয়া এ অনুভূতি আমাদের নিরাপদে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। ভয় পেলে আমাদের শরীরে বিশেষ হরমোন নিঃসৃত হয় যার প্রভাবে আমরা ভয়ের কারণগুলো এড়িয়ে চলি। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় ভয় পাওয়ার যুক্তি নেই এমন পরিস্থিতিতেও আমরা ভয় পাই যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই অযৌক্তিক এবং অতিরিক্ত ভয় বা আতংকের নামই হচ্ছে ফোবিয়া।
ভেনাসট্রাফোবিয়া বা সুন্দরী নারীকে ভয় পাওয়াও এক আতংকের নাম। আজকাল অনেকেই ভেনাসট্রাফোবিয়া শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে মনঃচিকিৎসকদের সংজ্ঞানুসারে একে এক ধরনের উদ্বিগ্নতা বলা হলেও ঠিক ফোবিয়া হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না।
রোমান পুরাণে ভেনাস ছিলেন ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের দেবী। আর ফোবিয়া হচ্ছে আতংক। কাজেই ভেনাসট্রাফোবিয়া হল সৌন্দর্য আতংক, এর আরেক নাম ক্যালিজাইনিফোবিয়া (Caligynephobia)। গ্রিক শব্দ calos অর্থ সুন্দর আর gyne অর্থ নারী। কাজেই ক্যালিজাইনিফোবিয়া অর্থ সুন্দরী নারী আতংক। এধরনের আতংকে ভোগা লোকেরা সুন্দরী নারীর উপস্থিতিতে বিব্রত হন এবং পুরো মাত্রায় প্যানিক এটাকে আক্রান্ত হন।
কারণ
স্বভাবজাত
গবেষকরা এধরনের আতংকের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর পেছনে অনেকগুলো কারণ জড়িত থাকে। অনেক পুরুষের একটি স্বভাবজাত আতংক কাজ করে। আবার অনেকে একটু বেশি মাত্রায় স্পর্শকাতর হয়ে থাকেন।
অতীতের বাজে অভিজ্ঞতা
অনেক মনঃচিকিৎসকের মতে প্রত্যক্ষ তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ফোবিয়া হতে পারে। হতে পারে ভেনাসট্রাফোবিয়ায় ভোগা কোন ব্যক্তি অতীতে কোন সুন্দরী নারীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন, কিংবা জনসম্মুখে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কাজেই সুন্দরী নারীর উপস্থিতি তাকে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সব সুন্দরী নারীকেই তিনি বিপদজনক মনে করতে থাকেন। ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কারণে সব পুরুষই যে ভেনাসট্রাফোবিক হয়ে ওঠেন তা নয়। কোন একটি ঘটনা বেশি মাত্রায় বেদনাদায়ক হলে কিংবা অনেকগুলো তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতিতে ভেনাসট্রাফোবিয়া দেখা দিতে পারে।
পর্যবেক্ষণ
এর পেছনে পারিবারিক কারণও থাকতে পারে। বাল্যকালে বাবা, বড় ভাই কিংবা বন্ধুদের মধ্যে ভেনাসট্রাফোবিয়া দেখে যে শিশু বড় হয়, সেও নিজের অজান্তে ভেনাসট্রাফোবিয়া নিয়ে বড় হয়ে ওঠে।
অতিরঞ্জিত তথ্য
এদিকে বাবা-মা, শিক্ষক এবং অন্যান্যদের নানা হিতাকাঙ্ক্ষী উপদেশ বা পরামর্শ এমনকি গণমাধ্যমে পাওয়া অতিরঞ্জিত তথ্যও ভেনাসট্রাফোবিয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে যাদের সহজে প্রভাবিত করা যায় এবং হীনমন্যতা-বোধ কাজ করে তাদের ক্ষেত্রে এমন ঝুঁকি বেশি।
মানসিক চাপ
অতিরিক্ত মানসিক চাপও একটি কারণ হতে পারে। কিছুটা চাপ আমাদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু অতিরিক্ত চাপ অনেক সময় সমস্ত মানসিক শক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলে যার ফলশ্রুতিতে ভেনাসট্রাফোবিয়া দেখা দিতে পারে।
আত্মবিশ্বাসের অভাব, হীনমন্যতা-বোধ, নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ এসব ভেনাসট্রাফোবিয়ার কারণ হতে পারে।
অন্যান্য ফোবিয়ার মত এক্ষেত্রেও কিছু সাধারণ শারীরিক এবং মানসিক লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে:
শারীরিক
- শিউরে ওঠা,
- শ্বাসকষ্ট,
- হৃৎস্পন্দন দ্রুত হওয়া,
- হাত ঘেমে যাওয়া,
- বমিভাব, বমি হওয়া, মাথাব্যথা।
মানসিক
- দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি,
- বিব্রত হওয়ার ভয়,
- বোকামো করে ফেলার এবং বিব্রত হওয়ার ভয়।
গুরুতর ক্ষেত্রে ভেনাসট্রাফোবিয়ায় ভোগা লোকেরা সম্পর্ক স্থাপনে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে পারেন, হীনমন্যতায় ভুগতে পারেন, পড়াশোনায় খারাপ করতে পারেন। যারা ভেনাসট্রাফোবিয়া সম্পর্কে সচেতন নন তারা ভেনাসট্রাফোবিয়ায় ভোগা লোকেদের মশকরার শিকার হতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে ভেনাসট্রাফোবিয়ায় ভোগা লোকেরা একাকী জীবন কাটিয়ে দেন।
অধিকাংশ ফোবিয়ার মত ভেনাসট্রাফোবিয়াও চিকিৎসা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে নিজেকে সম্মান করা বা আত্মসম্মানের দিকে নজর দেয়া, নিজের যত্ন নেয়া, ধ্যান, ব্যায়াম, ইতিবাচক চিন্তা, ইত্যাদি।
যেকোনো ফোবিয়া নিরাময়ে desensitization পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ অল্পমাত্রায় ধীরে ধীরে ভয়ের কারণের মুখোমুখি হতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। এছাড়া ভয়ের কারণ যে সত্যি নয় সে সম্পর্কেও রোগীদের সচেতন করে তুলতে হয়।