কফি কথন

শিহাব উদ্দিন আহমেদ | ডিসেম্বর ৩০, ২০২২

শোনা যায় সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ নারীরা ৬০ বছরের কম বয়সী পুরুষের জন্য কফি নিষিদ্ধের আবেদন করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল কফির কারণে পুরুষরা তাদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী খাদ্যপণ্যের তালিকায় কফিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সেটি ১৯৯১ সালের কথা। ২০১৬ সালে সে তালিকা থেকে কফিকে বাদ দেয়া হয়। এখন অবশ্য কফিকে স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবেই মনে করা হয়।

কফি শব্দটি এসেছে আরবের একপ্রকার মদের নাম থেকে। আরবিতে কফিকে বলা হত কাহওয়াহ (qahwah)। তুরস্কের উসমানীয়রা (অটোমান)একে বলতে শুরু করে কাহভি (kahve), যেখান থেকে ইংরেজি কফি শব্দের উৎপত্তি।

যেভাবে কফি-পানের শুরু

মনে করা হয় ইথিওপিয়ার কেফা অঞ্চল থেকে বুনো কফি চাষের জন্য আরবের দক্ষিণাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বলা হয় এক আরব রাখাল লক্ষ্য করেছিল কফি গাছের ফল খাওয়ার পর তার ছাগলগুলো বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে এবং রাতে ঘুমোচ্ছে না। সেই আরব রাখালের পর্যবেক্ষণই কফি যুগের সূচনা করেছিল। সুফিরা বিষয়টি জানতে পেরে কফি ফল থেকে পানীয় তৈরি করে যাতে সারারাত জেগে প্রার্থনা করা যায়।

কফির ক্রিয়া মানুষের নজরে আসার ঘটনাটি যেভাবেই ঘটুক না কেন, উত্তেজক পানীয় হিসেবে অ্যালকোহলের বিকল্প হিসেবে কফি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে কফি নিষিদ্ধ করার ঘটনাও ঘটেছে। শাস্তির ভয় উপেক্ষা করে কফির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। কফি হাউজ হয়ে ওঠে সংস্কৃতির অংশ। কফির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে মুক্তচিন্তার মানুষেরা কফি হাউজে একত্র হতেন। এটি অনেক শাসকের পছন্দ হয়নি।

পঞ্চদশ শতকের অটোমান সাম্রাজ্যে কফি বানানোর দক্ষতা ছিল স্ত্রী নির্বাচনের একটি মানদণ্ড। আবার বিয়ের পর যথেষ্ট পরিমাণ কফি কিনতে না পারলে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারতো। তবে পরের শতকেই সেখানে কফি পান নিষিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনা হয়।

ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে একের পর এর ইউরোপীয় দেশে কফিপানের সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়। ইতালিতেও অনেক খ্রিস্টান যাজক কফি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ১৬০০ সালে পোপ কফি পছন্দ করে ফেলায় কফি বৈধতা পায়। বলা যায় কফিকে ব্যাপ্টাইজ করা হয়।

চা নাকি কফি, কোনটি বেশি পান করা হয়?

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি পানীয়ের একটি হচ্ছে কফি; অন্য দু’টি হচ্ছে পানি এবং চা। পানির প্রসঙ্গ বাদ রেখে চা আর কফি মধ্যে কোনটি জনপ্রিয় বা বেশি পান করা হয় সে হিসেব করা যেতে পারে। ব্রিটিশরা চা পান করতে পছন্দ করে, চায়ের ব্যবসাও ছিল তাদের। তাই উপনিবেশগুলোতে চা পানের প্রসারে তারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এদিকে ইউরোপের মূল ভূখণ্ড আর আমেরিকায় কফি বেশ জনপ্রিয়।

প্রশ্ন হচ্ছে কোনটি বেশি জনপ্রিয়

২০১৩ সালের হিসেবে অনুযায়ী বিশ্বে প্রতিবছর ৮৫ লক্ষ মেট্রিক টন কফি উৎপাদিত হয়, আর চা উৎপাদিত হয় ৪৭ লক্ষ মেট্রিক টন। মানে কফি বেশি জনপ্রিয়? কিন্তু ভূগোলবিদ ডেভিড গ্রিগ মনে করেন এ হিসেবটি সঠিক নয়। তার যুক্তি হচ্ছে যেখানে এক কাপ চা বানাতে ২ গ্রাম চা প্রয়োজন হয় সেখানে এক কাপ কপি বানাতে ১০ গ্রাম কফি প্রয়োজন হয়। কাজেই বিশ্বে মোট কত কাপ চা আর কত কাপ কফি পান করা হয় সে হিসেব করতে হবে আমাদের। তার মতে প্রতি ১ কাপ কফির বিপরীতে বিশ্বে ৩ কাপ চা পান করা হয়। মানে চা-ই বেশি জনপ্রিয় পানীয়।

কাজেই কোনটি বেশি জনপ্রিয় সে প্রশ্নে আপনি চা কিংবা কফি যেকোনোটির পক্ষ নিতে পারেন। যা আপনি পছন্দ করেন!

ওয়েবক্যামেরা প্রযুক্তির পেছনে ছিল কফি

বলা যায় কিছু অলস কফিখোর বিজ্ঞানী সহজে কফি পানের জন্য ওয়েবক্যামেরা তৈরি করেছিলেন। ৯০ এর দশকের শুরুর দিকের কথা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও কেবল মূল ল্যাবেই কফি পট ছিল। অনেক সময়ই অন্যান্য ফ্লোরের ল্যাব থেকে গবেষকরা এসে দেখতেন কফি নেই। তাই তারা প্রতিটি ল্যাবের জন্য কফি পটের কথা না ভেবে বরং কফি পটের ছবি ক্যামেরার মাধ্যমে অনলাইনে দেখার ব্যবস্থা করেন। কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেমস কুয়েন্টিন স্ট্যাফোর্ড ফ্রেজার তাদের কম্পিউটারের ক্লায়েন্ট সফটওয়্যারের জন্য কোড লেখেন, তার সহকর্মী পল জার্ডেস্কি সার্ভারের জন্য কোড লেখেন। আরও পরে ১৯৯৩ সালের ওয়েব ব্রাউজারগুলো সেই ছবি দেখানোর উপযুক্ত হয়ে ওঠে। আর তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় এভাবে সাধারণ ব্যবহারকারীরাও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্যামেরার ছবি পাঠাতে পারে। সেটিই ওয়েবক্যামেরা যুগের শুরু।

কফি শরীরের জন্য ভালো

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পানীয় হিসেবে কফিকে স্বাস্থ্যকর পানীয় মনে করা হয়। এমনিতে কফি সুস্থ থাকতে এবং দীর্ঘজীবন লাভে সহায়ক হতে পারে। দিনে অন্তত তিন কাপ কফি পান করলে হার্ট অ্যাটাক-সহ বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকি কমে যেতে পারে। এছাড়া কফিতে থাকা ক্যাফেইন সতেজ থাকতে সাহায্য করে। তবে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য ক্যাফেইন ক্ষতিকর হতে পারে। সেসময় কফি নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় পান করা উচিত। ব্ল্যাক কফিতে বিশেষ ক্যালরি নেই। কিন্তু ক্রিম আর অতিরিক্ত সুগারসহ যে কফি দোকানে পরিবেশন করা হয় তা ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email
  • আরও পড়ুন:

  • প্রশ্ন ও উত্তর: