দ্রুতগতির ট্রেন কিংবা বিমানের ভেতরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে না তাকালে যে কারণে গতির বিষয়টি বোঝা যায় না, ঠিক সেকারণে দ্রুত গতিতে ঘুরতে থাকা পৃথিবীতে দাঁড়িয়েও এর গতির ব্যাপারটি উপলব্ধি করা কঠিন।
চলন্ত বাস বা ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছোট শিশু যেমন প্রশ্ন করে বসে ‘গাছগুলো পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে কেন’, ঠিক তেমনি পৃথিবীতে দাঁড়িয়েও দীর্ঘদিন মানুষ মনে করেছে পৃথিবীই স্থির। মানুষ ভেবেছিল, সূর্যসহ আকাশের সকল গ্রহ-নক্ষত্র বরং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এভাবেই মানুষ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের ব্যাখ্যা দিয়েছে।
কিন্তু পৃথিবী স্থির, সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এ তত্ত্ব ধর্মীয়ভাবে বেশ শক্ত ভিত পেলেও বৈজ্ঞানিক ভিত পায়নি। রাতের আকাশে কেন অনেক সময় তারাকে পেছনের দিকে যেতে দেখার পর আবার সামনের দিকে যেতে দেখা যায়- সে প্রশ্নের ব্যাখ্যা পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণার মাধ্যমে দেয়া সম্ভব ছিল না।
[পৃথিবী এবং মঙ্গল উভয়ই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। পৃথিবী মঙ্গলকে অতিক্রমের সময় আকাশে একবার মঙ্গলকে পেছনের দিকে যেতে দেখা যায়। এরপর আবার সেটিকে সামনের দিকে যেতে দেখা যায়।]
সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের আরেক প্রমাণ প্যারালাক্স
চেখের সামনে আঙুল রেখে বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখ দিয়ে আঙুলটিকে দেখার পর ডান চোখ বন্ধ করে বাম চোখ দিয়ে আঙুলটিকে দেখলে আঙুলের অবস্থান বদলে গেছে মনে হয়।
একইভাবে রাতের আকাশে অপেক্ষাকৃত কাছের তারাগুলোর অবস্থানও বছরের বিভিন্ন সময়ে বদলে যায়। ৩৬৫ দিনে পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। ফলে বছরের বিভিন্ন সময়ে আমরা আকাশকে বিভিন্ন অবস্থান থেকে দেখি। একারণেই বছরের বিভিন্ন সময়ে রাতের আকাশে অপেক্ষাকৃত কাছের তারাগুলোর অবস্থান বদলে যায়। এই প্যারালাক্স ব্যবহার করে তারার দূরত্বও বের করে ফেলা যায়।
পৃথিবী কতটা দ্রুত ঘুরছে?
নিজ অক্ষে আবর্তন করতে পৃথিবী প্রায়২৪ ঘণ্টা সময় নেয়। ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠে একটি রৈখিক গতি তৈরি হয়। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে এই বেগ সবচেয় কম আর বেগ সবচেয়ে বেশি বিষুবীয় এলাকায়। এখানে পৃথিবীর পরিধি সবচেয়ে বেশি, ২৪,৮৯৮ মাইল বা ৪০,০৭০ কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবী এই পুরো পরিধি ২৪ ঘণ্টায় অতিক্রম করছে।
এখান থেকে সহজেই বেগ বের করে ফেলা যায় (পরিধি/২৪ ঘণ্টা)। কাজেই বিষুবীয় এলাকায় পৃথিবীর বেগ ঘণ্টায় ১,০৩৭ মাইল বা ১,৬৭০ কিলোমিটার।
বিষুবীয় এলাকা থেকে মেরু এলাকার দিকে যেতে থাকলে এই বেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ৪৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ বা দক্ষিণ অক্ষাংশে এই বেগ ত্রিকোণমিতির কোসাইন (cosine) থেকে বের করা যায়। cosine 45 এর মান ০.৭০৭। কাজেই ৪৫ ডিগ্রি অক্ষাংশে পৃথিবীর বেগ ০.৭০৭×১০৩৭ = ৭৩৩ মাইল প্রতি ঘণ্টায় (১,১৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়)।
বিষুবরেখার কাছাকাছি এলাকা থেকে রকেট উৎক্ষেপণের কারণ
দেখা যাচ্ছে উত্তর বা দক্ষিণ মেরু থেকে যতই বিষুবীয় এলাকার দিকে যাওয়া যায় পৃথিবীর ঘূর্ণনজনিত রৈখিক বেগের মান তত বাড়তে থাকে। এ কারণে মহাকাশ সংস্থাগুলো বিষুবীয় এলাকার যতটা যতটা সম্ভব কাছাকাছি অবস্থান থেকে মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণের চেষ্টা করে। যাতে পৃথিবীর এই বেগের সাহায্য নিয়ে জ্বালানি খরচ কিছুটা কমানো যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেছে নিয়েছে ফ্লোরিডাকে আর সোভিয়েত ইউনিয়ন বেছে নিয়েছিল কাজাখস্তানের বাইকোনুরকে। আজকের রাশিয়াও কাজাখস্তানের বাইকোনুর উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকেই রকেট উৎক্ষেপণ করে চলছে।
পৃথিবী সূর্যকে কতটা দ্রুত প্রদক্ষিণ করছে?
এতক্ষণ আলোচনা করেছি ২৪ ঘণ্টায় নিজ অক্ষে পৃথিবীর আবর্তন নিয়ে। কিন্তু নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৃথিবী সূর্যকেও প্রদক্ষিণ করছে। এই বেগ ঘণ্টায় প্রায় ৬৭,০০০ মাইল বা ১০৭,০০০ কিলোমিটার।
পৃথিবী উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করলেও গাণিতিক জটিলতা কমানোর স্বার্থে কক্ষপথটিকে বৃত্তাকার ধরে নেয়া যায়। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব বা এই বৃত্তাকার কক্ষপথের ব্যাসার্ধ (r), ৯,২৯,৫৫,৮০৭ মাইল বা ১৪,৯৫,৯৭,৮৭০ কিলোমিটার। কাজেই বৃত্তাকার কক্ষপথের পরিধি 2 x π x r সূত্র থেকে বের করে নেয়া যায়। এটি ৫৮৪ মিলিয়ন মাইল বা ৯৪০ মিলিয়ন কিলোমিটার যা পৃথিবী প্রায় ৩৫৬ দিন ৬ ঘণ্টায় অতিক্রম করে। এখান থেকে পৃথিবীর বেগ বের করে নেয়া যায়। পৃথিবী ঘণ্টায় ৬৬,৬২৭ মাইল বা ১,০৭,২২৬ কিলোমিটার বেগে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
ছায়াপথে আমাদের সূর্যও পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলোকে সাথে নিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে
সূর্য মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৫,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আকাশ গঙ্গার ব্যাস অন্তত ১,০০,০০০ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আমরা মোটামুটিভাবে আকাশ গঙ্গার কেন্দ্র থেকে মাঝামাঝি দূরত্বে অবস্থান করছি। সূর্য এবং আমাদের সৌরজগত ঘণ্টায় ৪,৪৮,০০০ মাইল বা ৭,২০,০০০ কিলোমিটার বেগে ছায়াপথে ঘুরছে (সেকেন্ডে ২০০ কিলোমিটার)। এই প্রচণ্ড বেগে প্রদক্ষিণ করা সত্ত্বেও আকাশ গঙ্গা একবার ঘুরে আসতে সূর্যের প্রায় ২৩০ মিলিয়ন বা ২,৩০০ লক্ষ বছর লেগে যায়। বলাবাহুল্য সূর্যের সাথে সাথে আমাদের পৃথিবী, চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলোও আকাশগঙ্গা প্রদক্ষিণ করছে।
এদিকে অন্যান্য গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের সাপেক্ষে মিল্কিওয়ে ছায়াপথও স্থির নেই। মিল্কিওয়ের সবচেয়ে কাছের ছায়াপথ হচ্ছে এন্ড্রোমিডা। এ দু’টো ছায়াপথ পরস্পরের দিকে সেকেন্ডে ৭০ মাইল বা ১১২ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসছে। ফলে প্রায় ৪০০ কোটি বছর পর এদের মধ্যে সংঘর্ষ হবে। এক কথায় মহাবিশ্বের সবকিছুই গতিশীল। আমাদের পৃথিবীও প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে যা আমরা বুঝতে পারি না।