জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুকুল অবস্থা-
বন্ধুর ভূ-প্রকৃতি-
জলস্রোত বেগবতী না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব, কারণ জলের গতিবেগ টার্বাইনের চাকা ঘুরিয়ে ডায়নামো মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বন্ধুর ভূ-প্রকৃতির উপর দিয়ে প্রবাহিত নদী খরস্রোতা হয় এবং এর গতিবেগ ও বেশি থাকে। এ কারণে পার্বত্য নদী ও জলপ্রপাত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সহায়ক। এছাড়া সংকীর্ণ পার্বত্য উপত্যকায় বাঁধ নির্মাণ করাও সুবিধাজনক।
নিয়মিত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত-
নদীতে সারা বছর জলপ্রবাহ থাকা একান্ত প্রয়োজন। সেজন্য প্রয়োজন সারা বৎসরব্যাপী নিয়মিত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত। যেখানে সারাবছর বৃষ্টি হয় না সেখানে র্কত্রিম জলাশয় নির্মাণ করে তার মধ্যে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। তুষার গলা জলে পুষ্ট নদী জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সহায়ক, কারণ তাতে সারা বছর পানি প্রবাহ থাকে; যেমন, গঙ্গ নদী।
বরফ-মুক্ততা-
তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেলে পানি বরফে পরিণত হয় এবং তখন তা হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। কাজেই বরফ-মুক্ততাও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি অত্যাবশ্যক পূবশর্ত। আমেরিকা যক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নায়গ্রা জলপ্রপাত শীতকালে জমে যায় বলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়।
বনভূমি-
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বনভূমিরও কিছুটা (পরোক্ষ) প্রভাব আছে। প্রথমতঃ বনভূমি জলপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ করে এবং দ্বিতীয়তঃ এটি ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ করে। অধিক ভূমিক্ষয়ের ফলে নদীর পানি যদি অত্যধিক পলিযুক্ত হয় তবে বাঁধের পশ্চাতে নির্মিত জলাধার শীঘ্রই পলি জমে ভরাট হয়ে যাবে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রাদিও পলি জমার ফলে শীঘ্রই নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং জল অধিক পলিযুক্ত না হওয়াই শ্রেয়।
কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
কাপ্তাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। যা বন্দর নগরী চট্রগ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে অবস্থিত। কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১৯৬২ সালে এটি তৈরি করা হয়। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। ১৯৬২ সালে চালুর সময় এটি জাতীয় গ্রীডে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারত। পরবর্তী বছরগুলোতে এর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ২৩০ মেগাওয়াট করা হয়। এ প্রকল্প শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনেই নয় নিম্নাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে।
জলবিদ্যুৎ শক্তি ও তার সুবিধা-অসুবিধা
শুরুতে জলবিদ্যুৎ পরিচ্ছন্ন শক্তি বা ক্লিন এনার্জি মনে করা হলেও এখন আর তা মনে করা হচ্ছে না। এর পক্ষে বিপক্ষে নানা কথা এখন বলা হয়।
জলবিদ্যুৎ শক্তির ভান্ডার অফুরন্ত এবং এটি সাশ্রয়ী। যতদিন সূর্যতাপে পানি বাষ্পীভূত হয়ে পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত ঘটাবে ততদিন জলবিদ্যুতের সরবরাহ অফুরন্ত থাকবে। প্রতি অশ্বশক্তি জলবিদ্যুৎ মানেই ৪ মেট্রিক টন কয়লার সঞ্চয়। অল্প সংখ্যক জনবল দ্বারা এটি চালানো যায়। সাধারণত একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।
তবে এটি তৈরি ব্যয়বহুল, তেল গ্যাস কাছে পাওয়া গেলে অর্থাৎ সহজলভ্য হলে এরং ব্যবহার অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক হয় না। যদিও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম।
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, মাছের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। কারণ বাঁধের কারণে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর চলাচল ব্যাহত হয়।
টার্বাইন থেকে বের হওয়া পানিতে পলির পরিমাণ কম থাকে। ফলে নিম্নাঞ্চলে ভাঙন দেখা দিতে পারে। আর উজানে পলি জমে ভরাট হতে পারে। একারণে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। যেমন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ ৯০ বছর। পানি প্রবাহের যথেষ্ট হ্রাসবৃদ্ধি ঘটাতে হয় ফলে নিম্নাঞ্চলে ভাঙন বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ও যথেষ্ট ওঠানামা করে। বাঁধ থেকে বের হওয়া পানির তাপমাত্রা উজানের পানির চেয়ে যথেষ্ট কম হয়। সেটাও বিভিন্ন জলজ প্রজাতির জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
উষ্ণ এলাকার জলাধারগুলো যথেষ্ট পরিমাণে মিথেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন করে যা গ্রীন হাউস প্রভাব বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখে। প্লাবিত এলাকার উদ্ভিদকুলের পচন এর জন্য দায়ী। টার্বাইনের মধ্য দিয়ে পানি নিঃসরণের সময় মিথেন নির্গত হয়। ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যাম এর রিপোর্ট অনুযায়ী যেখানে উৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় জলাধার বেশ বড় (প্রতি বর্গমিটারে ১০০ ওয়াটের চেয়ে কম) সেখানে যদি জলাধার সৃষ্টির আগে বনাঞ্চল পরিষ্কার না করা হয়ে থাকে তবে সেখানে গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রচলিত তেল চালিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে বেশি।
অনেক মানুষকে পুনর্বাসিত করতে হয়। ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পনির নিচে চলে যেতে পারে। যা একটি অঞ্চলের মানুষের জন্য যথেষ্ট মনঃকষ্টের কারণ হতে পারে। কাপ্তাই লেক তৈরি হলে সে সময় পার্বত্য চট্রগ্রাম এলাকার একমাত্র দ্বিতল ভবন চাকমা রাজবাড়ী পানির নিচে তলিয়ে যায়। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে ১৮,০০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে জায়গা সরকারের হলেও মানবিক কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল কিন্তু অভিযোগ রয়েছে সবাই ক্ষতিপূরণ পায়নি। পানিপথে যাতায়াত সহজ হওয়াতে বনজ সম্পদ চুরি বেড়েছে, দূষণ বেড়েছে।