বৃষ্টির পানির এসিড ধর্ম বেড়ে গেলে তাকে এসিড রেইন বলা হয়। পানি একটি নিরপেক্ষ রাসায়নিক, অর্থাৎ এটি এসিড নয় আবার ক্ষারকও নয়। পানির pH মান হচ্ছে ৭। সে হিসেবে বৃষ্টির পানির pH ৭ হওয়ার কথা। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের উপস্থিতির কারণে বৃষ্টির পানি কিছুটা এসিডীয় হয়ে পড়ে। সাধারণত বৃষ্টির পানির pH ৫.৬ এর মত হয়ে থাকে।
সহজভাষায় pH এসিডের শক্তি নির্দেশক। pH মান যত কম হবে কোন রাসায়নিক দ্রব্য তত শক্তিশালী এসিড। বৃষ্টির পানির pH ৫.৬ হলে সেটিকে স্বাভাবিক ধরে নেয়া হয়। কিন্তু pH মান আরও কম হলে সেটিকে এসিড বৃষ্টি বলা হয়। বায়ুদূষণের কারণে যেসব এসিড রেইন হয় সাধারণত তার pH ৪.২ থেকে ৪.৪ এর মধ্যে হয়ে থাকে। অনেক সময় pH ৩ পর্যন্ত নেমে যেতে পারে আর ১৯৮২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে একবার কুয়াশার pH ১.৮-এ নেমেছিল।
এসিড রেইন যে কেবল সাধারণ বৃষ্টি আকারেই হবে তা নয়। শিলাবৃষ্টি, তুষার, কুয়াশা এবং ধূলার এসিড ধর্মও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোও এসিডীয় হয়ে উঠতে পারে। আবার এসিডীয় ধূলিকণা এবং গ্যাস অণু গাছপালা, বাড়িঘর প্রভৃতির ওপর জমতে শুরু করতে পারে এবং পরবর্তী বৃষ্টিতে এগুলো বৃষ্টির পানির সাথে মিশে এসিডীয় পানির প্রবাহ তৈরি করতে পারে যা ভূপৃষ্ঠের গাছপালা এবং জলাশয়ে থাকা উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
এসিড রেইনের প্রভাব
এসিড রেইনের ফলে অনেক জায়গায় জলাশয় এতটাই এসিডীয় হয়ে পড়েছে যে সেখানে জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। এছাড়া এসিড রেইনের ফলে মাটি থেকে উদ্ভিদের জন্য ক্যালসিয়ামের মত জরুরি খনিজ বৃষ্টির পানির সাথে চলে যেতে পারে। আবার মাটি থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত ধাতব পদার্থ বৃষ্টির পানির সাথে মিশে সরবরাহের পানিকে দূষিত করে তুলতে পারে।
বৃষ্টির পানির এসিড ধর্মের কারণেই মার্বেল এবং চুনাপাথরে নির্মিত বহু প্রাচীন শিল্পকর্ম নষ্ট হয়ে গেছে। মার্বেল এবং চুনাপাথর দু’টোই ক্যালসিয়াম কার্বনেট (CaCO3), তফাত শুধু তাদের স্ফটিক বা ক্রিস্টাল কাঠামোয়। সালফিউরিক এসিডের সাথে বিক্রিয়ায় ক্যালসিয়াম কার্বনেট ক্যালসিয়াম আয়ন তৈরি করে এবং বৃষ্টি পানির সাথে মিশে প্রবাহিত হতে শুরু করে।
তবে মার্বেল পাথরকে দুর্বল ভাবার কোন কারণ নেই। রোমান সভ্যতার যেসব নিদর্শন বৃষ্টির পানি থেকে সুরক্ষা পেয়েছে সেগুলো ২০০০ বছর পরেও বেশ ভালো অবস্থায় আছে।
প্রাকৃতিক এসিড বৃষ্টি
প্রাকৃতিক কারণেই বৃষ্টির পানির কিছুটা এসিড ধর্ম রয়েছে। এর প্রধান কারণ বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড। জীবজগতের শ্বসন ক্রিয়া এবং পচনের মাধ্যমে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের একটি অংশ পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড (H2CO3) তৈরি করে।
CO2 + H2O → H2CO3
এই কার্বনিক এসিড H+ আয়ন দানে সক্ষম, সহজভাষায় এটি পানির pH কমিয়ে দেয়।
H2CO3 → H+ + HCO3–
এদিকে বজ্রপাতের সময় বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ার মাধ্যমে নাইট্রিক অক্সাইড (NO) তৈরি করে।
N2 (g) + O2( g) → 2NO(g)
নাইট্রিক অক্সাইড পুনরায় অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ার মাধ্যমে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড তৈরি করে।
NO(g) + ½ O2 (g) → NO2 (g)
নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড পানির সাথে বিক্রিয়া করে নাইট্রিক এসিড তৈরির মাধ্যমে pH কমিয়ে দেয়।
3NO2 (g) + H2O(l) → 2HNO3 (aq) + NO(g)
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বেরিয়ে আসা সালফার ডাই অক্সাইডও এসিড বৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
মানবসৃষ্ট কারণে এসিড রেইন বা এসিড বৃষ্টি
এসিড রেইন নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে শিল্পায়নের ফলে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেশি হলেও বৃষ্টি পানির এসিড ধর্ম বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) এবং নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড (NOX), আর এদের উৎস মূলত শিল্প-কারখানা, সালফারযুক্ত জ্বালানি, জেনারেটর এবং যানবাহনের ইঞ্জিন। এসিড রেইন সৃষ্টিতে সক্ষম এসব গ্যাস বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে উৎপত্তিস্থল থেকে বহুদূরে গিয়েও এসিড রেইন ঘটাতে পারে।
এসিড রেইনে ২৫% এর মত ভূমিকা রাখে নাইট্রিক এসিড (HNO3), এটি তৈরি হয় গাড়ির ইঞ্জিন এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত নাইট্রিক অক্সাইডের মাধ্যমে। বাকি প্রায় ৭৫% এর জন্য দায়ী সালফিউরিক এসিড (H2SO4), এটি তৈরি হয় সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) এবং পানির বিক্রিয়ার মাধ্যমে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সালফার ডাই অক্সাইড নির্গত হলেও বায়ুমণ্ডলে সালফার ডাই অক্সাইডের প্রধান উৎস জীবাশ্ম জ্বালানি। দস্তা, তামাসহ বিভিন্ন ধাতুর আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনের সময়ও সালফার নির্গত হয়।
SO2 +O2 → SO3
SO3 + H20 → H2SO4
সালফিউরিক এসিডের H+ আয়ন দানের ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় এটি শক্তিশালী এসিড এবং পানির pH কমানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
H2SO4 → HSO4– + H+
সালফিউরিক এসিড পানিতে HSO4– এবং H+ আয়ন দানের পর সৃষ্ট HSO4– আয়ন আবার H+ আয়ন দান করতে পারে।
HSO4– → SO42- + H+
দুই দফায় H+ আয়ন দানের ফলে বৃষ্টি পানির pH নাটকীয়ভাবে কমে যায়, অন্যকথায় এসিড ধর্ম বেড়ে যায়।