রোগের সংক্রামণ সারাতে ব্যবহৃত ওষুধকে অ্যান্টিবায়োটিক বলে। ‘অ্যান্টি’ অর্থ ‘বিপক্ষে’ (against) এবং ‘বায়োটিক’ অর্থ ‘জীবন বা প্রাণ’ (life) । এন্টিবায়োটিক কিছু নির্দিষ্ট ধরনের জীবনের বিরুদ্ধে কাজ করে। এন্টিবায়োটিক তৈরিও হয় ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক কিংবা বড় গাছ থেকে।
১৯২৮ সালে স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং প্রথম এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেন। এটি ছিল পেনিসিলিন। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা আরও অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান করতে শুরু করেন। তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মাটি পরীক্ষা করে সংক্রামণ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার উপযোগী ছত্রাক খুঁজতে থাকেন যার ফলশ্রুতিতে আজ নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে স্ট্রেপটোমাইসিন, অরিওমাইসিন ক্লোরামফেনিকল, টেরামাইসিন, ইত্যাদি। এন্টিবায়োটিকগুলো সংক্রামণ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে ঠিকই কিন্তু কিছু এন্টিবায়োটিকের বিষক্রিয়াও রয়েছে।
নিউমোনিয়া, হুপিং কাশি, যক্ষ্মা, রেচনতন্ত্র, ত্বক এবং বিভিন্ন ক্ষত থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামণ সারানোর মাধ্যমে কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়ে চলেছে এন্টিবায়োটিক। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের অতি-ব্যবহার এবং অসতর্ক ব্যবহারের কারণে ঔষধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হচ্ছে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো একে একে অকার্যকর হয়ে পড়ছে আর আশংকা তৈরি হচ্ছে হয়ত আবার আগের মত নানা ধরনের সংক্রামণে বহু মানুষ মারা যাবে।
এন্টিবায়োটিক কিভাবে কাজ করে?
অ্যান্টিবায়োটিক কিভাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে তা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াগুলোর বেঁচে থাকার জন্য যে খাবার গ্রহণ প্রক্রিয়া তাতে বাধা সৃষ্টি করে। আবার কোষ বিভাজনের মাধ্যমে নতুন ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টিতেও অ্যান্টিবায়োটিক বাধা সৃষ্টি করে। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরকে আক্রমণ করে আর কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া কোষের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
এন্টিবায়োটিক কত প্রকার ও কি কি?
মোটা দাগে অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়: ব্রড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক এবং ন্যারো স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক। যেসব অ্যান্টিবায়োটিক নানা প্রকারের ব্যাটকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর তাদের ব্রড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক বলা হয়, যেমন অ্যামক্সিসিলিন। আর যেসব অ্যান্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর তাদের ন্যারো স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক বলা হয়, যেমন পেনিসিলিন।
সংক্রামণের ধরন বুঝে চিকিৎসকগণ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। সাধারণত দেখা যায় নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাকটেরিয়ার জন্য কোন নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক বেশি কার্যকর। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় নির্দিষ্ট এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকে এলার্জি আছে। তাই সেভাবে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। অনেক সময় ঠিক কোন অ্যান্টিবায়োটিকটি কাজ করবে সেটি জানার জন্য সেনসিটিভিটি পরীক্ষাও করা হয়।
এন্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
আর সব ওষুধের মত এন্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে। যখন এন্টিবায়োটিক জরুরি হয়ে পড়ে এবং সম্ভাব্য ক্ষতির চেয়ে প্রয়োজনটাই বেশি হয়ে পড়ে কেবল তখনই এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়। কাজেই অপ্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক সেবন করার অর্থ হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেয়া। যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে:
- ত্বকে ফুসকুড়ি, অ্যাজমা,
- পরিপাকতন্ত্রে অস্বাচ্ছন্দ্য, ডায়রিয়া, বমিভাবে, বমি,
- শরীরের ভেতরের অংশ যেমন মুখের ভেতর ফুসকুড়ি, মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনিপথের ভেতরেও ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
এছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে গুরুতর কিছু সমস্যা দেখা দেয়:
- লাগাতার ডায়রিয়া যার দ্রুত চিকিৎসা জরুরি হয়ে পড়ে,
- ত্বকে ফুসকুড়ি, জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট।
এন্টিবায়োটিক সেবনের ফলে বড় মাত্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসককে অবহিত করতে হবে।
সাধারণ সর্দি জ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জার (ফ্লু) ক্ষেত্রে কি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন?
এন্টিবায়োটিক সর্দি জ্বরের ক্ষেত্রে কোন উপকারে আসে না। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকগণ এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। এর কারণ হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক কেবল ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর, ভাইরাসের ক্ষেত্রে নয়। আর সর্দি জ্বর হয় ভাইরাসের কারণে যা এমনিতেই সেরে যায়।
এন্টিবায়োটিক সর্দি জ্বর দ্রুত সারাতে কিংবা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়া ঠেকাতেও কোন কাজে আসে না। এমনকি একজন থেকে আরেকজনে সংক্রামিত হওয়া প্রতিরোধেও অ্যান্টিবায়োটিক কোন কাজে আসে না।
সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকেদের ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেম বা শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসজনিত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রামণ এবং কিছু ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামণ এমনিতেই সারিয়ে নেয়।
যেসব ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে:
- হুপিং কাশির মত গুরুতর সংক্রামণ সারানোর জন্য,
- এইচআইভি সংক্রামণের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে,
- বয়স্ক কিংবা দুর্বল ব্যক্তি,
- শ্বাসতন্ত্রে সংক্রামণের আশংকা অতিমাত্রায় থাকলে।
অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন সেবনের জন্য এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়। আর এন্টিবায়োটিক যে কেবল রোগ সারানোর জন্যই দেয়া হয় তা নয়। অনেক সময় রোগ প্রতিরোধের জন্যও অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার মানুষের আয়ত্তে আসার ফলেই শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণের কারণে মৃত্যু এখন বিরল ঘটনা। সংক্রামণজনিত রোগগুলো এখন আর আগের মত বিপদজনক নয়।