হটলাইন বা লাল টেলিফোন কি?
জরুরি প্রয়োজনে যেমন, যুদ্ধ, জাতীয় দুর্যোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ গোপনীয়তা রক্ষা করে যোগাযোগের জন্য হটলাইন বা লাল টেলিফোন ব্যবহার করতে পারেন।
কেন?
হটলাইনের ধারণার সূত্রপাত পঞ্চাশের দশকে। সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থার প্রস্তাব করে। ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটন এবং মস্কোর মধ্যে প্রথম হটলাইন চালু হয়।
সেসময় রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছিল। সারা পৃথিবীতে তাদের প্রভাব বিস্তারের লড়াই তখন তুঙ্গে। উভয়ের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্রের বিশাল মজুদ। তাদের মধ্যে তখন দ্রুত যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না।
যদি কোন ভুল সংকেতের কারণে রাশিয়া ভেবে বসে যে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দিকে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে, বা যুক্তরাষ্ট্র ভেবে বসে যে রাশিয়া ছুঁড়েছে তবে পাল্টা আঘাত ছিল অনিবার্য। এভাবেই শুরু হয়ে যেতে পারতো পারমাণবিক যুদ্ধ। কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময় বিষয়টি আরও জোরালোভাবে অনুভূত হয়। একবার রাশিয়া থেকে পাঠানো একটি সমঝোতা বার্তা যুক্তারাষ্ট্রে পৌঁছুতে এবং পৌঁছাবার পর ডিকোড (সাংকেতিক ভাষার অর্থ উদ্ধার) করতে প্রায় ১২ ঘন্টা লেগে যায়। অথচ এই সময়ে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়টা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। এই পটভূমিতে হটলাইন স্থাপনের উদ্যোগ গতি পায়।
হটলাইন লাল নয়, টেলিফোনও নয়
চলচ্চিত্র বা টিভি সিরিজে যাই দেখানো হোক না কেন, হটলাইন লাল নয়, আর টেলিফোন তো নয়ই। এটি কখনো ছিলও না। অনেকটা টেলিগ্রাফের মত একটি যন্ত্রের মাধ্যমে সংকেত এনকোড করে পাঠানো হত এবং অপর প্রান্তে তা ডিকোড করা হত। এক প্রান্ত থেকে পাঠানো সংকেত অনুযায়ী অপর প্রান্তে ছাপা হত। দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ নিজ নিজ ভাষায় বার্তা পাঠাতেন এবং সেটা অনুবাদ করে নেয়া হত। পরে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংকেত আদান-প্রদান ব্যবস্থা চালু হয়, তারপরে আসে ফ্যাক্সিমিলি যার সাহায্যে ছবিও পাঠানো যেত। আর ২০০৮ সাল থেকে নিরাপদ ই-মেইল ব্যবস্থার মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছ।
শোনা যায় প্রয়োজন না থাকলেও রুশ এবং মার্কিন কর্মীরা পরীক্ষামূলক বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরস্পরের অনুবাদের দক্ষতা যাচাই করেন।
হটলাইন কেন টেলিফোন নয়
একটি স্পর্শকাতর পটভূমিতে এই হটলাইন চালু হয়েছিল। দু’পক্ষের ভাষাও এক নয় আর টেলিফোনের কথায় ভুল বোঝবোঝির আশংকা বেশি থাকে বলেই টেলিপ্রিন্টারের ব্যবস্থা করেছিলেন নেতারা।
ব্যবহার
ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাতেই ব্যবহৃত হয়েছে এই হটলাইন। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ তুরস্কের সাইপ্রাস দখল, আফগানিস্তানে রাশিয়ার সৈন্য প্রেরণ ইত্যাদি সময়ে পরস্পরকে সামরিক গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করতে হটলাইন ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া ১৯৭১ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল তখনও ব্যবহৃত হয়েছিল এই হটলাইন।
বাংলাদেশে
বাংলাদেশে যে ব্যবস্থাটি আছে সেটি হল লাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। শের-ই-বাংলা নগরে এই লাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অবস্থিত। বর্তমানে দেড় হাজার সংযোগ দিতে সক্ষম এই এক্সচেঞ্জ। পূর্বে এটি কপার তার নির্ভর থাকলেও এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফাইবার অপটিক কেবল ব্যবহৃত হয়। এই টেলিফোনের সুইচিং স্টেশন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। বিটিসিএল (সাবেক টিএন্ডটি) এই ফোন ব্যবস্থা পরিচালনা করলেও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স, ডিজিএফআই) একটি বিশেষ বিভাগ এই ফোনের গোপনীয়তা নিশ্চিত করে। এই ফোনে আড়িপাতা যায় না। বিশেষ প্রয়োজন, জাতীয় দুর্যোগ বা যুদ্ধকালীন সময়েও যাতে নেতারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারেন সেজন্য এই ব্যবস্থা।