ক্রনোমিটার কি?

শিহাব উদ্দিন আহমেদ | অক্টোবর ৯, ২০১৩

chronometer photoসহজভাষায় ক্রনোমিটার হচ্ছে সূক্ষ্ম ঘড়ি যা সমুদ্রে দ্রাঘিমা রেখা নির্ণয়ে ব্যবহৃত হত।

শত শত বছর আগে যখন সমুদ্রে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে জাহাজ চলাচল কেবল শুরু হয়েছে তখন সমুদ্র নিজের অবস্থান জানা নাবিকদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। অক্ষাংশ নির্ণয়টা সহজেই সেক্সট্যান্ট ব্যবহার করে করা সম্ভব হলেও, দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতিটি ছিল বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। আর সমুদ্রে সে পদ্ধতি প্রয়োগ করাও সম্ভব ছিল না।

দ্রাঘিমাংশ ঠিকমত নির্ণয় করতে না পারার কারণে সমুদ্রে জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটতে থাকে। এসময় বৃটিশ সরকার ঘোষণা দেয় দ্রাঘিমাংশ সমস্যার সমাধান দিতে পারলে ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ পাউন্ড পুরস্কার দেয়া হবে। জন হ্যারিসন নামে জনৈক বৃটিশ কাঠমিস্ত্রি প্রায় সারা জীবন ব্যয় করেন এর পেছনে। তিনি কোন স্থানের স্থানীয় সময় এবং গ্রীনিচ সময়ের ব্যবধান থেকে দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের কথা ভাবেন।

কিন্তু এজন্য প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম ঘড়ি। সে সময়কার পেন্ডুলাম বা দোলক ঘড়ি একাজের জন্য যথেষ্ট ছিল না। জাহাজের দলুনি পেন্ডুলামের দোলনে প্রভাব ফেলে, এছাড়া পৃথিবীর সব স্থানে পৃথিবীর আকর্ষণ সমান না হওয়ায় দোলনকালও এক থাকে না। সমুদ্রের বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রার ব্যবধানটাও একটা সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।

কিন্তু জন হ্যারিসন যাকে খুব একটা শিক্ষিত বলা যায় না, তিনি সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতি বের করেন। তিনি স্প্রিং এবং দ্বি-ধাতব পাত ব্যবহার করে প্রায় ৩১ বছর ধরে একে একে চারটি ক্রনোমিটার তৈরি করেন। চতুর্থ ক্রনোমিটারটি নিয়ে তিনি পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতা করেন এবং তার ক্রনোমিটারটি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম ছিল।

১৭৬১-৬২ সালে তার ক্রনোমিটারটি নিয়ে আটলান্টিকের ওপরে পাঁচ মাস ধরে পরীক্ষা করা হয়। এসময় ক্রনোমিটারটি ব্যবহার করে দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ে মাত্র ১/ মিনিটের বিচ্যুতি হয়েছিল। ১৭৬৩ সালে তিনি ঘোষিত অর্থের সামান্য একটি অংশ পুরস্কার হিসেবে পান। অবশ্য ১৭৭৩ সালে রাজা তৃতীয় জর্জের হস্তক্ষেপে পুরো টাকা পান। এরপর আরও অনেকই ক্রনোমিটারের উন্নয়নে এগিয়ে আসে।

ক্রনোমিটারের সাহায্যে দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়

  • সূর্য ঠিক মাথার ওপরে কিনা এটা সেক্সট্যান্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। স্থানীয় সময় ১২টায় সূর্য ঠিক মাথার ওপর থাকে।
  • ক্রনোমিটার থেকে একই সময়ে গ্রীণিচের স্থানীয় সময় জেনে নেয়া হয়। গ্রীণিচের দ্রাঘিমাংশ হচ্ছে ০ ডিগ্রী।
  • স্থানীয় সময় গ্রীণিচ সময়ের চেয়ে কম হলে সেটি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ এবং বেশি হলে পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।
  • পৃথিবী ২৪ ঘন্টায় একটি ঘূর্ণন সম্পন্ন করে, অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে আসে। মানে ১ ঘন্টায় ১৫ ডিগ্রী ঘোরে এবং ৪ মিনিটে ১ ডিগ্রী ঘোরে।
  • এবার ধরা যাক, কোন স্থানে যখন বেলা ১২টা, গ্রীণিচে তখন সকাল ৭টা।  মানে সময় ব্যবধান ৫ ঘন্টা।
  • তাহলে দ্রাঘিমাংশের পার্থক্য, chronometer eqnডিগ্রী।
  • গ্রীণিচের চেয়ে এগিয়ে থাকায় এটি ৭৫ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।

এভাবে সেক্সট্যান্ট এবং ক্রনোমিটার ব্যবহার করে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করে সমুদ্রে অবস্থান নির্ণয় করা যায়।

পরে ঘড়িতে বেতার তরঙ্গের ব্যবহার চালু হয়। আর এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জিপিএস ব্যবহার করে সহজেই অবস্থান নির্ণয় করা যায়।

অবশ্য ক্রনোমিটার কেবল সমুদ্রে জাহাজ চলাচলেই নয় অনেক ক্ষেত্রেই যেখানে সময়ের সূক্ষ্মতা প্রয়োজন সেখানে ব্যবহৃত হয়। এখন সুইস অফিসিয়াল ক্রনোমিটার টেস্টিং ইনস্টিটিউটের সনদ পাওয়া ঘড়িগুলোকেই ক্রনোমিটার বলে। কাজেই ক্রনোমিটার এখন সূক্ষ্মতার প্রতীক।

Print Friendly, PDF & Email
  • আরও পড়ুন:

  • প্রশ্ন ও উত্তর: