পৃথিবীর চুম্বকত্ব বা ভূ-চুম্বকত্ব

শিহাব উদ্দিন আহমেদ | জুলাই ১৫, ২০১৬

Earths-Magnetic-Fieldষোড়শ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন আমাদের পৃথিবী নিজেই বিশাল একটি চুম্বকের মত আচরণ করে। চুম্বকের বিপরীত মেরু যেমন পরস্পরকে আকর্ষণ করে তেমনি পৃথিবীর মেরু দু’টিও মুক্তভাবে ঝুলে থাকা চুম্বকের মেরু দু’টিকে আকর্ষণ করে। যেন পৃথিবীর ভেতরে বিশাল একটি দণ্ড চুম্বক বসানো রয়েছে।

পৃথিবীর এ চৌম্বক ধর্ম জাহাজের নাবিকদের খুব কাজে এসেছিল। তারা চুম্বক কম্পাস ব্যবহারের মাধ্যমে দিক নির্ণয় করে জাহাজ চালাতে শুরু করেন ফলে মহাসমুদ্রে আর হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলো না।

কিন্তু পৃথিবীর অভ্যন্তরের প্রচণ্ড উত্তাপে এরকম বিশাল কোন দণ্ড চুম্বক টিকতে পারার কথা নয়। পৃথিবীর চুম্বকত্বের কারণ সে সময়কার বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না আর এখনো তা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে পৃথিবীর চুম্বকত্বের কারণ হিসেবে কিছু তত্ত্বের কথা বলা হয়। সে আলোচনা একটু পর।

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা, সৌর ঝড় থেকে সুরক্ষা

পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র থাকায় আমরা চুম্বক কম্পাস ব্যবহার করে দিক নির্ণয় করতে পারি সেটি আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়া পরিযায়ী পাখি এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রমের সময় দিক নির্ণয়ে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সাহায্য নেয়। সাধারণ চুম্বকের মত পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রেরও বলরেখা আছে। সৌর ঝড়ের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন চার্জিত কণিকা পৃথিবীর চৌম্বক বলরেখার কারণে আটকে যায়। এসব চার্জিত কণিকা সরাসরি পৃথিবীতে এসে পড়লে তা যেমন জীবজগতের জন্য হুমকি তেমনি পৃথিবীর যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। অনেক গ্রহেই এরকম চৌম্বক ক্ষেত্র না থাকায় সেখানে সরাসরি বিভিন্ন ক্ষতিকারক রশ্মি আছড়ে পড়ছে।

পৃথিবীর উত্তর মেরু আসলে চৌম্বক দক্ষিণ মেরু

Earths-Magnetic-Field-2চুম্বকের ধর্ম হচ্ছে এর উত্তর মেরু অন্য চুম্বকের দক্ষিণ মেরুকে আকর্ষণ করে। কাজেই চুম্বক কম্পাসের উত্তর মেরু যেহেতু পৃথিবীর উত্তর মেরুর দিকে মুখ করে থাকতে চায় তাই বলতে হয় পৃথিবীর ভৌগলিক উত্তর মেরু আসলে চৌম্বক দক্ষিণ মেরু। শুধু তাই নয় পৃথিবীর ঘূর্ণনের ওপর ভিত্তি করে যে ভৌগলিক উত্তর মেরুর কথা আমরা বলি চৌম্বক মেরু আসলে সেখান থেকে ১১ ডিগ্রি দূরে অবস্থিত। তাই বলতে হয় পৃথিবীর ভৌগলিক মেরু আর চৌম্বক মেরু এক নয়।

পৃথিবীর চৌম্বক ধর্মের কারণ

এক কথায় বললে বলতে হয় প্রচলিত তত্ত্বানুসারে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের কারণ এর অভ্যন্তরে গলিত ধাতুর প্রবাহ।

বিশাল এক গ্যাসীয় গোলক হিসেবে জন্ম নেয়ার পর তাপ বিকিরণ করে ঠাণ্ডা হতে হতে পৃথিবী আজকের অবস্থায় এসেছে বলে ধারণা করা হয়। ভারী বস্তু যেমন পানিতে ডুবে যায় তেমন পৃথিবীতে লোহার মত ভারী বস্তুগুলো কেন্দ্রের দিকে জমা হতে শুরু করে। এ কারণে পৃথিবীর কেন্দ্র মূলত লোহা দ্বারা গঠিত। কেন্দ্রের তাপমাত্রা সূর্য পৃষ্ঠের তাপমাত্রার মত হলেও প্রচণ্ড চাপে এখানকার লোহা কঠিন অবস্থায় থাকে। লোহার কুরি বিন্দু ৭৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ৭৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ওপরে লোহার চৌম্বক ধর্ম থাকে না। কিন্তু এ লোহাই পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের জন্ম দিয়েছে।

Inside-Earthপৃথিবীর প্রচণ্ড উত্তপ্ত কেন্দ্রের ওপরে রয়েছে লোহাসহ তরল ধাতুর স্তর। এ তরল ম্যাগমা নামে পরিচিত। আর এর ওপরেই থাকে পৃথিবীর কঠিন ভূত্বক বা শিলাস্তর। তরল অংশটি কেন্দ্রের উত্তপ্ত অংশের সংস্পর্শে এস আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং ফুটন্ত পানি যেভাবে পাত্রের তলা থেকে ওপরের দিকে উঠে আসে এই তরল ধাতুগুলোও সেভাবে বাইরের দিকে ভূত্বকের কাছাকাছি চলে আসে। একে বলা হয় পরিচলন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকে। এর সাথে যুক্ত হয় পৃথিবীর ঘূর্ণন ক্রিয়ার প্রভাব। এ দু’য়ের সমন্বয়ে অনেকটা পেঁচানো পথে তরল ধাতুর প্রবাহ চলতে থাকে। ধাতুর স্তরের মধ্যে ঘর্ষণ ক্রিয়াও হয়। ফলে তরল ধাতুর এ প্রবাহ বিদ্যুৎ প্রবাহের মতই কাজ করে। ফ্যারাডের নিয়মানুযায়ী পরিবাহী বিদ্যুতের তার যেভাবে চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করে পৃথিবীর অভ্যন্তরে গলিত ধাতুর প্রবাহও সেভাবে চৌম্বকক্ষেত্রে তৈরি করে। একে বলা হয় ডায়নামো ইফেক্ট।

এখানে উল্লেখ করা যায়, পৃথিবীর অভ্যন্তরে গলিত ধাতুর প্রবাহ না থাকলে বা পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীরে হলে পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হত না। শুক্র গ্রহের অভ্যন্তরের গঠন পৃথিবীর মত হলেও এর ঘূর্ণন ধীরে হওয়ায় শুক্র গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্র নেই।

যাকে আমরা পৃথিবীর চৌম্বক মেরু বলছি তা কিন্তু সব সময় এমন ছিল না। আজ যেখানে উত্তর মেরু সেখানে এক সময় ছিল দক্ষিণ মেরু। পৃথিবী সৃষ্টির পর এ পর্যন্ত ১৭০ বার পৃথিবীর চৌম্বক মেরুদ্বয় অবস্থান পাল্টেছে। বিস্তারিত দেখুন: পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর উল্টে যাওয়া

Print Friendly, PDF & Email
  • আরও পড়ুন:

  • প্রশ্ন ও উত্তর: