প্যান্ট তৈরিতে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাপড় হচ্ছে জিনস। অন্যান্য পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হলেও প্যান্ট তৈরিতেই জিনসের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জিনসের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণ কি আর কবে থেকেই-বা জিনসের সূচনা হয়েছিল সেটি জানতে হলে আগে জানতে হবে জিন্স বলতে আমরা কি বুঝি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকের দিনে জিন্স ফ্যাশনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও এর সূচনা হয়েছিল শ্রমজীবী মানুষের পোশাক হিসেবে। ষোড়শ শতক থেকে জিন্স শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় শ্রমজীবী মানুষের জন্য তৈরি শক্ত ও টেকসই পোশাকই জিনস হিসেবে পরিচিতি পায়। এসব পোশাক তৈরি হত ইতালির জেনোয়া এলাকায়। সেই থেকে এসব পোশাক পরিচিতি পায় জিন হিসেবে। এদিকে কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রান্সের নিম (Nimes) এলাকার তাঁতিরাও একই ধরনের কাপড় তৈরি করতে শুরু করেন, এসব কাপড় পরিচিতি পায় ডি নিম (de Nimes) হিসেবে। যার অর্থ নিমে তৈরি। এ থেকেই জিনসের আরেক নাম ডেনিম।
প্রেরণা ছিলেন এক খনি শ্রমিকের স্ত্রী
ষোড়শ শতকের সেই জিন্স বা ডেনিমের সাথে আজকের দিনের জিন্সের অবশ্য কিছু পার্থক্য আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রিভিট। এটি যুক্ত হয়েছিল ডেভিস নামে এক লাতভিয়ানের হতে। ১৯ শতকের কথা। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাভাদায় বিক্রয়কর্মীর কাজ করতেন তিনি। খনি শ্রমিকদের মাঝে প্যান্ট বিক্রি করে ভালোই উপার্জন করছিলেন। শোনা যায় একবার এক খনি শ্রমিকের স্ত্রী এসে অনুযোগ করেন তার স্বামীর প্যান্টের পকেটে প্রায়ই ছিঁড়ে যায়। সেই খনি শ্রমিকের স্ত্রী জ্যাকব ডেভিসকে অনুরোধ করেন তিনি যেন একটি উপায় বের করেন।
এ নিয়ে ভাবতে শুরু করে জ্যাকব ডেভিস। ঘোড় সওয়ার এর আসন বা ঘোড়ার জিনের অনুকরণে রিভিট এর ব্যবহার শুরু করেন। প্যান্টের যেসব জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি সেসব জায়গায় ধাতব রিভিট বসিয়ে দেন। কাজেই আপনি যদি জিন্সের প্যান্ট পরা অবস্থায় এ লেখাটি পড়তে থাকেন তবে লক্ষ্য করুন প্যান্টের সামনে এবং পেছনে বোতামের মত যে রিভিট আছে কিনা। যদি থাকে তবে নিশ্চিত থাকুন সেগুলো কেবল সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য বসানো হয়নি।
রিভিট যুক্ত প্যান্টের কার্যকারিতা এবং জনপ্রিয়তা দেখে নিজের উদ্ভাবনের গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেননি জ্যাকব ডেভিস, তিনি বুঝেছিলেন ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে সোনার খনির চেয়েও লোভনীয় হয় উঠবে এ ব্যবসা। কিন্তু এ উদ্ভাবনকে ব্যবহার করে ব্যবসা করার মত টাকা তাঁর হাতে ছিল না। লিভাই স্ট্রাউস নামে এক ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হয় জ্যাকব ডেভিসের। লিভাই স্ট্রাউসের টাকা দিয়েই ১৮৭৩ সালে রিভিট যুক্ত প্যান্টের পেটেন্ট করিয়ে নেন ডেভিস-স্ট্রাউস জুটি। একই বছর বড় মাত্রায় জিন্সের প্যান্ট উৎপাদন শুরু করেন তারা।
তারা অবশ্য প্রথম দিকে দু’ধরনের জিনস বিক্রি করতে শুরু করেন। একটি ছিল আজকের দিনের জনপ্রিয় নীল জিনস আর অন্যটি তাঁবু টানানোর কাপড়ের মত কাপড়ে তৈরি প্যান্ট। নীল জিন্সই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং অচিরেই ডেভিস-স্ট্রাউস জুটি কেবল নীল জিন্স বিক্রি করতে শুরু করেন। তাঁবু তৈরির কাপড়ের চেয়ে ডেনিম বা জিন্স জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ হল এগুলো সময়ের সাথে সাথে নরম (soft) হতে থাকে যেটি তাঁবু তৈরির কাপড়ের ক্ষেত্রে হয় না। এ তো গেল ডেনিম জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ। কিন্তু নীল রঙটি বেছে নেয়ার কারণ কি?
নীল জিনস কেন জনপ্রিয়?
সে সময় আমেরিকায় নীল চাষের ফলে প্রাকৃতিক নীল রঙটি ছিল সবচেয়ে সহজলভ্য এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে প্যান্টে যেসব দাগ পড়ে তা লুকোতে নীল রঙ ছিল সবচেয়ে কার্যকর। এসব কাপড়ে কেবল বাইরের অংশে অল্পমাত্রায় নীল রঙ প্রয়োগই যথেষ্ট ছিল। ফলে এসব প্যান্ট পরলে পায়ে রঙ লেগে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল না। আবার সময়ের সাথে সাথে নীল রঙ হালকা হয়ে গেলেও সেটি ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। অনেকে এখন আগে থেকেই রং উঠিয়ে হালকা করে তোলা জিন্স পরতে পছন্দ করেন।
শ্রমজীবী এবং রাখালদের পোশাক যেভাবে সর্বত্র জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবনধারার প্রতি আকর্ষণ প্রথম দিকে জিন্সের জনপ্রিয়তার পেছনে কাজ করেছিল। পরবর্তী সময়ে অনেকেই কর্মস্থলের বাইরে জিন্স পরতে শুরু করেন। ১৯৫০ এর দশকে বিভিন্ন মার্কিন চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে জিন্স পরতে দেখা যায়। যেসব চরিত্র সমাজের প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সেটিই লুফে নিয়েছিল সে সময়কার তরুণ প্রজন্ম। জিন্সের জনপ্রিয়তা আরও বহুগুণ বেড়ে যায় আশির দশকে যখন যৌনতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি হতে থাকে।