রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার উপায়

মার্চ ৩০, ২০২০

How to boost your immune system photo

বিভিন্ন ধরনের কোষ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, প্রোটিন এবং টিস্যুর সমন্বয়ে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ করে, যার ফলে আমাদের শরীর নানা ধরনের ক্ষতিকর রোগজীবাণু ধ্বংস করতে পারে।

এই ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে চাইলেই শক্তিশালী করে তোলা যায় না। আর সেটি সম্ভব হলেও তা আমাদের জন্য বরং ক্ষতিকর হত। কারণ সেক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেম আমাদের প্রয়োজনীয় কোষ এবং টিস্যুগুলোকেও মেরে ফেলতে শুরু করবে।

তবে কিছু পুষ্টি উপাদান এবং ভিটামিন আমাদের ইমিউন সিস্টেম ঠিকঠাক মত কাজ করার জন্য জরুরি। এগুলোর মধ্যে ভিটামিন ডি ছাড়া সবকিছুই আমরা স্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে সহজে পেয়ে যেতে পারি।

আপনার স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের অভ্যাস থাকলে ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করার জন্য আলাদা করে কোন ওষুধ সেবন করার প্রয়োজন নেই, তাতে কোন কাজও হবে না। তবে পুষ্টিহীনতা থাকলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কিছু দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে।

ভিটামিন ডি

অস্থি, অস্থিসন্ধি এবং পেশীর যত্নে ভিটামিন ডি যে কার্যকরী সেটা আগে থেকেই জানা ছিল। তবে এখন মনে করা হচ্ছে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমের ওপরও ভিটামিন ডি এর প্রভাব রয়েছে। ভিটামিন ডি এর অভাবে সংক্রামণের আশংকা বাড়ে এবং অটোইমিউন রোগ দেখা দিতে পারে।

(আটোইমিউন রোগ: যে রোগ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে নিজের শরীরকেই আক্রমণ করে বসে।)

আমাদের জন্য ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস হচ্ছে সূর্যের আলো। সূর্যের আলোর প্রভাবে আমাদের চামড়ার নিচে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। কিন্তু শীতকালে যখন সূর্যের আলো খুব একটা পাওয়া যায় না এবং সূর্যের আলোর তীব্রতা কমে আসে তখন অনেকক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভিটামিন ডি তৈরি হয় না।

ভিটামিন ডি এর অন্যান্য উৎস: তৈলাক্ত মাছ, ডিমের কুসুম, মাংস, মগজ, কলিজা, ইত্যাদিতে অল্প পরিমাণে ভিটামিন ডি থাকে। এরপরও অনেকের ক্ষেত্রেই শীতর মাসগুলোতে ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবনের প্রয়োজন হয়।

জিঙ্ক বা দস্তা

জিঙ্কের অভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এমনও দেখা গেছে ঠাণ্ডা লাগার লক্ষণ দেখা দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জিঙ্ক ট্যাবলেট সেবন করলে ঠাণ্ডা লাগার তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব কমিয়ে দেয়া যায়। সামুদ্রিক খাবার, মাংস, শিমজাতীয় শস্য, ডালসহ বিভিন্ন খাবারে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে।

ভিটামিন বি

ভিটামিন বি-৬, বি-১২ এবং বি-৯ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। ভিটামিন বি এর অভাবে অ্যান্টিবডি, শ্বেত রক্ত কণিকা তৈরিসহ অন্যান্য কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে, ফলশ্রুতিতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

মাছ, মাংস, ডিম, দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবারে ভিটামিন বি-১২ পাওয়া যায়। আলাদাভাবে ভিটামিন বি সেবন না করলে নিরামিষভোজীদের মধ্যে ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

এদিকে ভিটামিন বি-১২ ঠিকমত শোষণের জন্য ভিটামিন বি-৬ প্রয়োজন। এছাড়া ইমিউন সিস্টেমের কোষ এবং লোহিত রক্ত কণিকা তৈরির জন্যও ভিটামিন বি-৬ প্রয়োজন।

গরুর কলিজা, ছোলা, টুনা মাছ, স্যামন মাছ, চাল, ছোলা, যব, পেঁয়াজ ইত্যাদি খাবারে ভিটামিন বি-৬ পাওয়া যায়।

ভিটামিন বি-৯ বা ফলিক এসিড: গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের নিউরাল টিউব তৈরিতে যাতে কোন ত্রুটি না থাকে সেটি নিশ্চিত করতে প্রথম তিন মাসে মায়েদের ভিটামিন বি-৯ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়।

সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম, শিমজাতীয় শস্য, সামুদ্রিক খাবার, ডিম এবং মাংসে এ ধরনের ভিটামিন পাওয়া যায়।

ভিটামিন সি

ইমিউন সিস্টেমের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য ভিটামিন সি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলমূল এবং শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ক্ষত সারিয়ে তুলতে এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে ভিটামিন সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্ত চার্জিত আয়ন বা free radical শরীরের সুস্থ কোষ, টিস্যু, এবং জেনেটিক উপাদানের ক্ষতি করার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। এই free radical নিষ্ক্রিয় করার কাজটি করে ভিটামিন সি। বড় আকারের একটি কমলালেবু থেকে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি পাওয়া যায়। তবে ধূমপায়ীদের ভিটামিন সি এর চাহিদা কিছুটা বেশি থাকে।

অন্ত্রের অণুজীব

আমাদের অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাসসহ অসংখ্য অণুজীব থাকে। এছাড়া থাকে জীবাণু-রোধী কোষ বা ইমিউন সেল। দেখা গেছে অন্ত্রে থাকা অণুজীব সেখানকার ইমিউন সেলগুলোর ওপরও প্রভাব রাখে। কাজেই প্রিবায়োটিক এবং প্রোবায়োটিকের মাধ্যমে আমরা আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে আরও কার্যকর করে তুলতে পারি। অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা আঁশজাতীয় খাবার খেতে পারি (প্রিবায়োটিক)। আর উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিকের উৎস হতে পারে দই, ছানা, ঘোল আর পনিরের মত খাবার।

ওমেগা ৩

আমাদের কোষকে আবৃত করে থাকা মেমব্রেনের অপরিহার্য উপাদান ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড। এগুলো তিন ধরনের হয়ে থাকে। EPA, DHA এবং ALA । আমাদের শরীর ALA তৈরি করতে পারে না। তাই এটির জন্য আমাদের খাবারে ওপর নির্ভর করতে হয়।  আমাদের শরীর ALA থেকে খুব অল্প পরিমাণে EPA এবং DHA তৈরি করতে পারে। ফলে এগুলোর জন্যও আমাদের খাবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। উদ্ভিদজাত তেল, বাদাম এবং বীজে ALA পাওয়া যায়। EPA এবং DHA পাওয়া যায় তৈলাক্ত মাছে। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে আমাদের ইমিউন সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বি সেল। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এই বি সেলের কাজে গতি আনে।

How to boost your immune system photo

সুষম খাবারের পাশাপাশি ব্যায়ামও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে।

ব্যায়াম

সুষম খাবারের পাশাপাশি ব্যায়ামও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে। ব্যায়ামের ফলে মাংসপেশি এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। ফলে শরীরের দূরতম প্রান্তের কোষগুলোতেও পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছানো সম্ভব হয়। তবে সুফল পেতে সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার কিংবা ৭৫ মিনিট পরিশ্রমী ব্যায়াম করতে হবে, অবশ্যই ঘাম ঝরাতে হবে।

মানসিক চাপ

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর মানসিক চাপের প্রভাব সম্পর্কে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত তথ্য নেই। হঠাৎ করে তীব্র মাত্রার মানসিক চাপ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় করে তোলে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে মানসিক চাপ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। এধরনের মানসিক চাপ কর্টিসল হরমোনের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কিছুটা হলেও দুর্বল করে তোল।

ঘুম

পর্যাপ্ত ঘুম না হলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টার ঘুম রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া কোন রোগের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করলে ঘুমের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে দ্রুত সেরে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

মদ্যপান

অ্যালকোহল পানের নানা ক্ষতিকারক প্রভাবের একটি হচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়া। কাজেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কার্যক্ষম রাখতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি পান করা উচিত হবে না। সবচেয়ে ভালো হয় মদ্যপান স্থগিত রাখা।

আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম খাবার, মানসিক চাপ, ঘুম, শারীরিক পরিশ্রমসহ অনেক কিছুর সাথে জড়িত। এখানে কেবল কয়েকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হল।

Print Friendly, PDF & Email
  • আরও পড়ুন:

  • প্রশ্ন ও উত্তর: