কোন কিছু কম বোঝাতে সাধারণত ইনফ্রা (infra-) প্রিফিক্স বা উপসর্গটি ব্যবহৃত হয়। তাই ইনফ্রারেড অর্থ দাঁড়ায় লালের চেয়েও কম। দৃশ্যমান আলোগুলোর মধ্যে লাল আলোর কম্পাংক সবচেয়ে কম। ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোর কম্পাংক তার চেয়েও কম। খালি চোখে দেখা না গেলেও অন্ধকারে ছবি তোলা, টেলিভিশনের মত যন্ত্রপাতির রিমোট কন্ট্রোলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইনফ্রারেড আলো ব্যবহার করে চলেছি আমরা।
সূর্যের আলো যে সাতটি রঙের সমন্বয়ে গঠিত সেটি বিজ্ঞানী নিউটন অনেক আগেই দেখিয়েছিলেন। কিন্তু বর্ণালীতে লাল আলোর পর যে আরও আলো আছে তা জানা গিয়েছিল ১৮০০ সালে। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হার্শেল (William Herschel) একটি প্রিজমের মাধ্যমে সূর্যের আলোকে বিভিন্ন রঙের আলোয় বিভক্ত করেন, যেমনটি নিউটন অনেক আগেই করেছিলেন। এরপর উইলিয়াম হার্শেল বিভিন্ন রঙের আলোয় থার্মোমিটার রেখে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিমাপ করেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন কোন রঙের আলো থার্মোমিটারকে বেশি উত্তপ্ত করছে।
এ পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি লক্ষ্য করেন বর্ণালীতে লাল আলোর পরের যে অন্ধকার এলাকা সেখানেও থার্মোমিটারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ধরা পড়ছে। এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হার্শেল বলেন, নিশ্চয়ই সেখানে এমন কোন আলো আছে যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না।
দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীতে বেগুনী রঙের আলোর কম্পাংক সবচেয়ে বেশি। এরপর কম্পাংক ধীরে ধীরে কমতে থাকে আর লাল আলোর কম্পাংক সবচেয়ে কম। বলা যায় এই কম্পাংকের পরিবর্তনই আমাদের চোখে ভিন্ন ভিন্ন রঙের আলো হিসেবে ধরা দেয়। হার্শেলের চিহ্নিত করা সে আলোর কম্পাংক স্বাভাবিকভাবেই লালের চেয়েও কম। আর তাই এর নাম ইনফ্রারেড, লালের চেয়েও কম বা অবলোহিত।
ইনফ্রারেড আলোক তরঙ্গের কম্পাংক 3 GHz থেকে 400 THz আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য 30 সেন্টিমিটার থেকে 740 ন্যানোমিটার।
তরঙ্গের ক্ষেত্রে সবসময়ই কম্পাংক কমার অর্থ হচ্ছে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া। আর দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই ইনফ্রারেড আলোয় খুব বেশি শক্তি থাকে না, যা আমাদের চোখের রেটিনার পক্ষে সনাক্ত করা সম্ভব।
প্রকৃতপক্ষে বেতার তরঙ্গ, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি, এক্স-রে, মাইক্রোওয়েভ, দৃশ্যমান আলো এবং ইনফ্রারেড আলো সবই তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের অংশ। ইনফ্রারেড আলো খালি চোখে দেখা না গেলেও আমরা এ রশ্মির তাপ অনুভব করতে পারি।
তাপ এবং আলোর সম্পর্ক
উত্তপ্ত যেকোনো বস্তুই আলো বিকিরণ করে। তা সে আকাশের তারাই হোক আর আমাদের চারপাশের সাধারণ বস্তুই হোক। এমনকি ৯৮০ ফারেনহাইট তাপমাত্রার মানবদেহ থেকেও আলোক তরঙ্গ নি:সৃত হয়। আলোর কম্পাংক বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর সীমার বাইরে হলে আমরা দেখতে পাই না।
আবার কোন বস্তু থেকে কি ধরনের আলো নি:সৃত হবে তা নির্ভর করছে বস্তুটির তাপমাত্রার ওপর। তাপমাত্রা যত বাড়ে তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত কমে। আমাদের সূর্যের তাপমাত্রা ৫,৭৭৮ কেলভিন (৯,৯৪০০ ফা.)। প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে (০.৪ – ০.৭ মাইক্রন) সূর্যের আলোর তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। অথচ আমাদের শরীর থেকে নির্গত ইনফ্রারেড আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১০ মাইক্রন।
পরিবহন, পরিচলন ও বিকিরণ এই তিন পদ্ধতিতে তাপ সঞ্চালিত হয়। বিকিরণের ক্ষেত্রে তাপ সঞ্চালনে মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত রশ্মি। কোন কিছুর তাপমাত্রা -২৭৩০ সে. এর বেশি হলেই সেখান থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি আকারে তাপ নির্গত হয়। সূর্য থেকে নির্গত শক্তির অর্ধেক ইনফ্রারেড আলো আকারে নির্গত হয় এবং নির্গত দৃশ্যমান আলোর একটি বড় অংশ সূর্যেই শোষিত হয়ে ইনফ্রারেড আলো আকারে নির্গত হয়।
সাধারণ যে বৈদ্যুতিক বাতি আমরা ব্যবহার করি তার ১০ ভাগের মত আলোয় রূপান্তরিত হয় আর বাকি ৯০ ভাগ ইনফ্রারেড আলোর রূপ নিয়ে তাপ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক হিটারের ক্ষেত্রেও তাই। দৃশ্যমান আলো আকারে কিছু শক্তি নির্গত হয় ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগটাই নির্গত হয় ইনফ্রারেড আকারে।
টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোলেও ব্যবহৃত হচ্ছে ইনফ্রারেড আলো। সেখানে বিশেষ লাইট ইমিটিং ডায়োড বা এলইডি ব্যবহার করা হয় যেগুলো থেকে দৃশ্যমান কোন আলো নির্গত হয় না। এর বদলে ইনফ্রারেড আলো নির্গত হয়। এই এলইডি দ্রুত জ্বলা-নেভার মাধ্যমে বাইনারি (ডিজিটাল) সংকেত পাঠায়।