গোয়েন্দা উপন্যাস বা রসায়নে আগ্রহীদের কাছে অদৃশ্য কালি একটি পরিচিত বিষয়। দু’টি বিশ্বযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দারা অদৃশ্য কালি ব্যবহার করেছে। অবশ্য শুধু গোপন তথ্য প্রেরণই নয়, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও অদৃশ্য কালি ব্যবহার করা হয়। অনেক দেশে ডাক বিভাগের স্বয়ংক্রিয় চিঠি বাছাই বা ফর্ম বাছাই-এর কাজে সুবিধার জন্য অদৃশ্য কালির বার কোড ব্যবহার করা হয়।
অদৃশ্য কালি কি?
অদৃশ্য কালি এমন বিশেষ ধরনের কালি যেটি ব্যবহার করে লিখলে লেখাটি দেখা যায় না, ফলে কেউ জানতে পারে না যে ওখানে কিছু লেখা আছে। পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় লেখাটি ফুটিয়ে তোলা হয়। এভাবে গোপনবার্তা আদান প্রদান করা হয়।
কিভাবে কাজ করে?
অদৃশ্য কালি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কিছু কালি আছে যেগুলো দিয়ে লিখলে কিছুটা সময় দৃশ্যমান থাকার পরে মিলিয়ে যায়; পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। আবার কিছু কালি আছে যা একেবারেই দেখা যায় না।
প্রক্রিয়াটি মূলত রাসায়নিক। লিটমাস দ্রবণ বা লিটমাস পেপার যেমন ক্ষার বা এসিডে রং বদলায়, অদৃশ্য কালির ব্যাপারটাও তেমন হতে পারে। আবার কিছু কালি আছে যেগুলো তাপ প্রয়োগে রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে ফুটে ওঠে। আবার কিছু কালি আছে যেগুলো আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনী রশ্মিতে ফুটে ওঠে। ইদানীং কম্পিউটার প্রিন্টারের জন্যও অদৃশ্য কালি পাওয়া যায়।
চারপাশের অনেক রাসায়নিকই আছে যেগুলো অদৃশ্য কালি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু গোয়েন্দাদের এমন রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয় যা সহজে ধরা যায় না।
নিজেই তৈরি করুন অদৃশ্য কালি
বেকিং সোডা
সমপরিমাণ বেকিং সোডা এবং পানি মিশিয়ে নিন। তৈরি হয়ে গেল অদৃশ্য কালি। টুথপিক বা সূক্ষ্ম ব্রাশের সাহায্যে কাগজে গোপন বার্তা লিখুন। কাগজটি শুকিয়ে গেলে কিছুই দেখা যাবে না। এরপর একটি ব্রাশের মাধ্যমে কাগজটিতে আঙ্গুরের রস লাগালে লেখা ফুটে উঠবে। আঙ্গুরের রসের এসিড এবং বেকিং সোডার বিক্রিয়ায় লেখা ফুটে ওঠে।
দুধ ও লেবু
একইভাবে দুধ বা লেবুও ব্যবহার করা যায় অদৃশ্য কালি হিসেবে। তবে লেখা ফুটিয়ে তুলতে হলে কাগজটিকে উত্তপ্ত করতে হবে। এজন্য ইস্ত্রি বা ১০০ ওয়াটের বাল্ব ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে হ্যালোজেন বাতি ব্যবহার করা যাবে না। দুধ এবং লেবু দু’টিই মৃদু ধরনের এসিড যা শুকিয়ে যাওয়ার পরও কাগজে থেকে যায়। উত্তাপে কাগজের এসিডীয় বা অম্লীয় অংশটুকু অন্যান্য অংশের চেয়ে আগে পুড়ে (রাসায়নিক বিক্রিয়ায়)বাদামী বর্ণ ধারণ করে।
সাদা মদ, ভিনেগার, আপেল বা কমলার রস ইত্যাদিও ব্যবহার করা যায়।
ক্রেয়ন
সাদা কাগজের ওপর সাদা ক্রেয়নের সাহায্যে লিখলে সেটি দেখা যায় না। কিন্তু জল রং দিয়ে ব্রাশ করলে লেখা ফুটে ওঠে। বলাবাহুল্য এসব পদ্ধতি বাস্তবক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী নয়।
তাপ প্রয়োগে ফুটিয়ে তোলা যায় এমন কয়েকটি অদৃশ্য কালি
- কোলা পানীয়
- মধুর দ্রবণ
- লেবু, আপেল, কমলা বা পেয়াজের রস (তাপ প্রয়োগে কাগজ এবং জৈব এসিড মিলে এস্টার তৈরি করে।)
- দুধ
- প্রাণীদেহের তরল; যেমন, মূত্র, বীর্য, লালা বা রক্তরস
- সাবান পানি
- চিনির দ্রবণ
- মদ বা ভিনেগার
- কোবাল্ট ক্লোরাইড (তাপ প্রয়োগে নীল বর্ণ ধারণ করে, কিছু সময় পর আবার সাদা হয়ে যায়। অবশ্য অতিরিক্ত উত্তপ্ত করলে পূর্বের রং ফিরে পায় না।)
রাসায়নিকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হয় এমন কয়েকটি অদৃশ্য কালি
- ফেনলথেলিন (phenolphthalein): pH নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ক্ষার, যেমন এমোনিয়ার ধোঁয়া বা সোডিয়াম কার্বনেটে গোলাপি বর্ণ ধারণ করে ।
- আয়রন সালফেট: সোডিয়াম সালফাইড প্রয়োগ করতে হয়।
- সোডিয়াম ক্লোরাইড: সিলভার নাইট্রেট প্রয়োগ করতে হয়।
এরকম আরও অনেক রাসায়নিক আছে।
আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনী রশ্মির ব্যবহার
কিছু পদার্থ আছে যা আলট্রাভায়োলেট রশ্মিতে প্রতিপ্রভা (আলো আপতিত হলে বস্তু কর্তৃক অন্য বর্ণের আলো নি:সরণ) ধর্ম দেখায়। সেসব পদার্থকে অদৃশ্য কালি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আবার কিছু কাগজ রয়েছে যার প্রতিপ্রভ বৈশিষ্ট্য আছে। এমন কাগজে অন্য অদৃশ্য তরল ব্যবহার করে লিখলে কিছু চোখে পড়ে না। এসব লেখা সহজেই আলট্রাভায়োলেট ল্যাম্পে ধরা পড়ে।
আদর্শ অদৃশ্য কালি
পেশাদার গোয়েন্দারা এমন সব রাসায়নিককে অদৃশ্য কালি হিসেবে বেছে নেয় যেগুলো প্রচলিত রাসায়নিকে ধরা পড়ে না, গন্ধ নেই, তাপ প্রয়োগ বা আলট্রাভায়োলেট ল্যাম্পেও ধরা পড়ে না।