মাইক্রোগ্রাভিটি বা জিরো গ্রাভিটি

শিহাব উদ্দিন আহমেদ | মার্চ ১৫, ২০১৫

Microgravity-1প্রথমে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া ভালো, মাইক্রোগ্রাভিটি আর জিরো-গ্রাভিটি কথাগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও শুদ্ধভাবে বলতে গেলে মাইক্রগ্রাভিটি অর্থে জিরো-গ্রাভিটি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা যায় না।

শব্দগত অর্থ

অতিক্ষুদ্র কিছু বোঝাতে ‘মাইক্রো’ উপসর্গটি (Prefix)ব্যবহার করা হয়। কাজেই মাইক্রোগ্রাভিটি হল এমন অবস্থা যেখানে পৃথিবীর আকর্ষণ বলের প্রভাব খুব কম। আর জিরো গ্রাভিটি হচ্ছে এমন অবস্থা বা জায়গা যেখানে আকর্ষণ বল একেবারেই কাজ করছে না।

‘জিরো-গ্রাভিটি’ শব্দগুচ্ছ যে কারণে সঠিক নয়

মহাকাশে কোন কিছুর আকর্ষণ বল কাজ করে না এ ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ২০০-২৫০ মাইল উচ্চতায় থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র পৃথিবীকে আবর্তন করে। এই উচ্চতায় পৃথিবীর আকর্ষণ বল কিছুটা কম অনুভূত হয় ঠিকই কিন্তু তা কোনভাবেই শূন্য নয়।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের উচ্চতায় আপনার ওজন শূন্য নয়

Microgravity-2এখানে পৃথিবীর আকর্ষণ বল ভূপৃষ্ঠের ৯০%। অর্থাৎ পৃথিবীপৃষ্ঠে স্প্রিং নিক্তিতে আপনার ওজন ১০০ কেজি হলে মহাকাশ কেন্দ্রে আপনার ওজন হবে ৯০ কেজি (কেজি ওজনের একক নয়, সে জটিলতায় যাচ্ছি না)। তবে কেন মহাকাশ কেন্দ্র নভোচারীরা ভেসে বেড়ান, দেখে মনে হয় কোন আকর্ষণ বলই সেখানে নেই? সে আলোচনা একটু পর।

জিরো গ্রাভিটি নেই

মহাকাশের যেখানেই আপনি যান না কেন, কোন না কোন গ্রহ-নক্ষত্রের আকর্ষণ সেখানে থাকবেই। তাই জিরো গ্রাভিটি কোথাও পাওয়া যায় না। কিন্তু বহুদূরে থাকা গ্রহ-নক্ষত্রের আকর্ষণ বল অতি নগণ্য হয়ে পড়ে সেটাকেই বলা হয় মাইক্রোগ্রাভিটি।

পৃথিবী তার আকর্ষণ বলের মাধ্যমেই চাঁদকে কক্ষপথে ধরে রেখেছে, একইভাবে সূর্যও তার আকর্ষণ বলের মাধ্যমে পৃথিবীকে কক্ষপথে ধরে রেখেছে। এই আকর্ষণ বল না থাকলে পৃথিবী সূর্যকে ছেড়ে বহুদূরে চলে যেত।

ওজনহীনতা

Microgravity-4ধরুন আপনি উচ্চগতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, একটি সেতু অতিক্রমের পর বা ঢালু পাহাড়ি পথে নেমে আসছেন। তখন কি অন্য রকম অনুভূতি হয়? এই অন্যরকম অনুভূতির কারণ ওজন কমে আসা। মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুতে ওজনহীনতা অনুভূত হয় আর একারণে কেবল (cable) ছিঁড়ে লিফট নিচে পড়ে গেলে লিফটের আরোহীরা ওজনহীন অনুভব করেন। লিফটের কেবল ছিঁড়ে নিচে পড়ে যাওয়ার সময় কেউ যদি হাত থেকে কয়েন ফেলে দেয় তবে কয়েনটি তার সাথেই নিচে নামতে থাকবে আর তিনি মনে করবেন কয়েনটি ভেসে আছে।

মহাকাশ কেন্দ্রও একই রকম ঘটনা ঘটে। মহাকাশ কেন্দ্রকে একটি পড়ন্ত বস্তুর সাথে তুলনা করা যায়। ধরুন একটি কামান থেকে গুলি ছোঁড়া হল। এক্ষেত্রে কামানের গোলা হচ্ছ পড়ন্ত বস্তু, এটি একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে মাটিতে পড়বে। একটি বাঁকানো গতিপথ অতিক্রম করে কামানের গোলা এগিয়ে যায়। এই বাঁক যদি পৃথিবীর বাঁকের মতই হয় তাহলে কিন্তু কামানের গোলা কখনই মাটিতে পড়বে না। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে। এই কামানের গোলা এটি একটি পড়ন্ত বস্তু।

মহাকাশ কেন্দ্রের ব্যাপারটাও এরকম। ঘণ্টায় ১৭,৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলা মহাকাশ কেন্দ্র একটি পড়ন্ত বস্তু, কিন্তু এর গতিপথ পৃথিবীর বাঁকের মতই। ফলে এটি কখনো মাটি এসে পড়ে না। আর একটি পড়ন্ত বস্তুর ভেতরে থাকা মহাকাশচারীরাও নিজেদের ওজনহীন অনুভব করেন। মহাকাশ কেন্দ্রে যে অভিকর্ষজ ত্বরণ একেবারেই নেই তা নয়, এখানে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান 1×10-6g । পৃথিবীর বুকে ৭০০ পাউন্ড ওজনের যন্ত্রপাতিও নভোচারীরা মহাকাশ কেন্দ্রের ওজনহীন পরিবেশে অনায়াসে তুলে ফেলতে পারেন।

পৃথিবীতে ওজনহীনতা

Microgravity-5মহাকাশ কেন্দ্রের ওজনহীনতার কারণ এর গতি। কাজেই একই পদ্ধতিতে পৃথিবীতেও ওজনহীনতার স্বাদ নেয়া যায়। ঢালু পথে দ্রুত গাড়ি চালানো বা রোলার কোস্টারের বাঁকে নামার সময় কিছুটা ওজনহীনতার অনুভূতি পাওয়া যায়। এদিকে প্রায় ওজনহীন পরিবেশে দহন বা প্রবাহী পদার্থবিজ্ঞানের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার। প্রায় ৫০০ ফুট গভীর একটি টাওয়ার থেকে ফ্রি ফল বা মুক্তভাবে পতনের মাধ্যমে ওজনহীন পরিবেশ তৈরি হয়। এই পতনে মাত্র ৫ সেকেন্ডের মত সময় লাগে। এছাড়া অধিবৃত্তাকার পথে বিশেষভাবে তৈরি বিমানের দ্রুত পতনের মাধ্যমে ওজনহীন পরিবেশ তৈরির উপায় বের করেছে নাসা। এসব বিমানে একটানা ২০-২৫ সেকেন্ড ওজনহীনতার স্বাদ নেয়া যায়। এরপর বিমান আবার ওপরে ওঠে এবং একইভাবে আবার দ্রুত নেমে আসে। এভাবে কিছু সময় পর পর ওজনহীনতার স্বাদ নেয়া যায় এসব বিমানে। ‘এপোলো ১৩’ চলচ্চিত্রের ওজনহীন পরিবেশের দৃশ্য এমনই একটি বিমানের ভেতর ধারণ করা হয়েছিল।

Print Friendly, PDF & Email
  • আরও পড়ুন:

  • প্রশ্ন ও উত্তর: