পোলোনিয়াম ২১০

শিহাব উদ্দিন আহমেদ | নভেম্বর ৯, ২০১৩

পোলোনিয়াম ২১০ কি?

poloniumপোলোনিয়াম ২১০ হচ্ছে পোলোনিয়ামের একটি আইসোটোপ। এটি যে কেবল তেজস্ক্রিয় একটি পদার্থ তাই নয়, রাসায়নিক ধর্মের বিচারেও এটি বিষাক্ত। এটি হাইড্রোজেন সায়ানাইডের তুলনায় আড়াই লক্ষগুণ বেশি বিষাক্ত। মূল ক্ষতিটা হয় আলাফা কণা নি:সরণে।

বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি এবং মেরী কুরি তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখতে পান কিছু ইউরেনিয়াম আকরিক বা পিচব্লেন্ড ইউরেনিয়ামের চেয়েও বেশি তেজস্ক্রিয়। তাঁরা সিদ্ধান্তে আসেন পিচব্লেন্ডে এমন কিছু আছে যা ইউরেনিয়ামের চেয়েও তেজস্ক্রিয়। এটা অনুসন্ধান করতে গিয়েই আবিষ্কৃত হয় নতুন একটি মৌল, যা ইউরেনিয়ামের চেয়েও বেশি তেজস্ক্রিয়। তাঁরা ১৮৯৮ সালে এই আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। মেরী কুরির মাতৃভূমি পোল্যান্ডের নামানুসারে এই মৌলটির নামকরণ করা হয় পোলোনিয়াম।

পোলোনিয়ামের সংক্ষেপ

পর্যায় সারণীর গ্রুপ ১৬ এর মৌল এটি। বেশ উদ্বায়ী, ৫৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৪৫ ঘন্টাতেই অর্ধেকটা উবে যায়।

  • প্রতীক: Po
  • পারমাণবিক সংখ্যা: ৮৪
  • পারমাণবিক ভর: ২১০
  • গলনাঙ্ক: ২৫৪ সে.
  • স্ফুটনাঙ্ক: ৯৬২ সে.
  • ঘনত্ব: ৯.৪ গ্রাম/ঘন সে.মি.
  • আপেক্ষিক গুরুত্ব: ৯.৩
  • জারণ অবস্থা: −2, +2, +3, +4, +6
  • ইলেকট্রন বিন্যাস: 1s22s22p63s23p63d104s24p64d104f145s25p65d106s26p4

পোলোনিয়াম প্রকৃতিতে অত্যন্ত দুর্লভ, এমনকি পিচব্লেন্ডেও খুব বেশি পলোনিয়াম থাকে না। ১,০০০ টন পিচব্লেন্ড থেকে মাত্র ৪০ মিলিগ্রাম পোলোনিয়াম পাওয়া সম্ভব। ভূ-স্তরে অত্যন্ত অল্প পরিমাণে পোলোনিয়াম থাকে। পোলিনিয়ামের ৩৩টি আইসোটোপের কথা জানা গেছে। কোনটির অর্ধায়ু এক সেকেন্ডেরও কম, আবার কোনটির ১০৩ বছর। তবে প্রকৃতিতে সবচেয়ে বেশি যে আইসোটোপটি পাওয়া যায় সেই পোলোনিয়াম-২১০ এর অর্ধায়ু ১৩৮.৪ দিন।

তেজস্ক্রিয়তা

পোলোনিয়াম-২১০ আলফা কণা নির্গমণের মাধ্যমে সীসা-২০৬ এ পরিণত হয়। এক্ষেত্রে কেবল ধনাত্নক চার্জযুক্ত আলফা কণাই নির্গত হয়, গামা রশ্নি নয়। প্রতি এক লাখ ক্ষয়ে কেবল একবার গামা রশ্নি নির্গত হয়।

Curieউৎস

ইউরেনিয়াম ২৩৮-এর ক্ষয়ের ফলে পোলোনিয়াম ২১০ তৈরি হয়, একারণে প্রকৃতিতে পোলোনিয়াম ২১০ খুব অল্প পরিমাণে পাওয়া যায়। ইউরেনিয়াম খনিজ বা আকরিক থেকে খুব সামান্য পোলোনিয়াম পাওয়া সম্ভব। অবশ্য রেডন ২২২ এর ক্ষয় থেকেও পোলোনিয়াম ২১০ তৈরি হয়, একারণে বায়ুমন্ডলে এবং ভূপৃষ্ঠে খুব অল্প পরিমাণে পোলোনিয়াম ২১০ পাওয়া যায়। গাছ খুব সামান্য পরিমাণে পোলোনিয়াম শোষণ করে। বৃহৎ পত্র বিশিষ্ট উদ্ভিদের পাতায় পোলোনিয়াম সঞ্চিত হওয়ার হার তুলনামূলকভাবে বেশি। তামাকের পাতায় তুলনামূলকভাবে বেশি পোলোনিয়াম ২১০ থাকে যা বায়ুমন্ডল থেকে জমা হয়, এ কারণে সিগারেটের ধোঁয়ায়ও অল্প পরিমাণে পোলোনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা থাকে। এটি ক্যান্সারের একটি কারণ। মানবদেহেও খুব সামান্য পরিমাণে পোলোনিয়াম থাকে।

প্রতিবছর কেবল ১০০ গ্রামের মত পোলোনিয়াম ২১০ তৈরি করা হয়, যে কারণে এটি অত্যন্ত দুর্লভ। বিসমাথ ২০৯ কে থার্মাল নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে বিসমাথ ২১০ তৈরি হয়, এটি তেজস্ক্রিয় এবং অর্ধায়ু ৫ দিন। এটি ভেঙে পোলোনিয়াম ২১০ তৈরি হয়। এ জন্য পারমাণবিক চুল্লী বা রিয়্যাক্টর প্রয়োজন হয়।

শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত পোলোনিয়াম ২১০ আসলে হত্যা উদ্দেশ্যে ব্যবহারোপযোগী থাকে না। এজন্য বেশি পরিমাণে পোলোনিয়াম প্রয়োজন, যা তৈরি করতে কণাত্বরক (পার্টিকেল এক্সিলারেটর) কিংবা পারমাণবিক চুল্লী প্রয়োজন। অবশ্য ইউরেনিয়াম খনিজ বা রেডিয়াম ২২৬ থেকেও পোলোনিয়াম ২১০ তৈরি পাওয়া বা তৈরি করা যায়, কিন্তু সেজন্য অত্যন্ত উন্নত ধরনের ল্যাবরেটরী প্রয়োজন।

 

ব্যবহার

বেরিলিয়াম এর সাথে পোলোনিয়াম ২১০ এর মিশ্রণ নিউট্রন রশ্নির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফটোগ্রাফিক ফিল্ম বা ক্যামেরার লেন্স থেকে ধুলিকণা অপসারণ, কিংবা কোন যন্ত্রাংশ/স্থান থেকে স্থির বিদ্যুৎ অপসারণে পোলোনিয়াম ২১০ ব্যবহার করা হয়।

পোলোনিয়াম ২১০ থেকে অনেক বেশি পরিমাণে আলফা রশ্নি নির্গত হয়। এক গ্রাম পোলোনিয়াম এক সেকেন্ডেই ১৪০ ওয়াট শক্তি বিকিরণ করতে পারে। মানে এক গ্রাম পোলোনিয়ামের একটি ক্যাপসুল নিজে থেকেই ৫০০ সে. তাপমাত্রায় পৌঁছে যেতে পারে। এ বৈশিষ্টৈর জন্য একে স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের থার্মোইলেকট্রিক সেলের শক্তির উৎস হিসেব ব্যবহার করা হয়েছে। আবার রাতে চন্দ্র পৃষ্ঠে বিচরণকারী রোভারের যন্ত্রপাতি উষ্ণ রাখতেও এটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে পোলোনিয়ামের অর্ধায়ু কম হওয়ায় এটির ব্যবহার আর হচ্ছে না।

বিষক্রিয়া

পোলোনিয়াম আলফা কণা নি:সরণ করে, আলাফা কণার শক্তি টিস্যু ধ্বংস করতে যথেষ্ট। কিন্তু আলফা কণা নি:সরণকারী পোলোনিয়াম ২১০ অতটা বিপদজনক নয়, কারণ বায়ুতে এটি কয়েক সেন্টিমিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না। কাগজ বা আমাদের দেহের বাইরের দিকের মৃত টিস্যুই এসব আলফা কণিকা আটকে দেবার জন্য যথেষ্ট। কেউ পোলোনিয়াম ২১০ এর সংস্পর্শে এলেও হাত ভালোভাবে ধুয়ে ফেললে বা গোসল করে ফেললেই যথেষ্ট। তবে এটি খেয়ে ফেললে বা শরীরের ভেতরে প্রবেশ করলে বিপদ। তখন এর তেজস্ক্রিয়তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। পানীয়, খাবার, শ্বাসগ্রহণ বা ক্ষতস্থানের মাধ্যমে এটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এর বায়োলজিক্যাল হাফ লাইফ বা অর্ধায়ু (শরীরের ভেতরে অর্ধেক হতে প্রয়োজনীয় সময়) প্রায় ৫০ দিন। পোলোনিয়াম ২১০ এর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও কোন অসুবিধা নেই। তবে অক্রান্ত ব্যক্তির দেহ নি:সৃত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করলে বিপদ হতে পারে। পোলোনিয়াম ২১০ এর প্রয়োগজনিত অসুস্থতা চিকিৎসকের পক্ষে সহজে সনাক্ত করাও সম্ভব হয় না।

আলোচিত ব্যবহার

ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং পক্ষত্যাগকারী রুশ গোয়েন্দা আলেকজান্ডার লিতভিনেনকোকে পোলোনিয়াম ২১০ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে বলে বলা হয়। ইয়াসির আরাফাতের ক্ষেত্রে অভিযোগ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আর আলেকজান্ডার লিতভিনেনকোর ক্ষেত্রে অভিযোগ রাশিয়ার বিরুদ্ধে।

Print Friendly, PDF & Email
  • আরও পড়ুন:

  • প্রশ্ন ও উত্তর: