রেডিও কার্বন ডেটিং

শিহাব উদ্দিন আহমেদ | নভেম্বর ৮, ২০১৭

radiocarbon-dating

অমুক দেশের তমুক জায়গায় ম্যামথ বা বিশাল কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেছে যার বয়স এত বছর, এমন খবর মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। কিন্তু কিভাবে ফসিলের বয়স নির্ণয় করেন বিজ্ঞানীরা? ফসিলের বয়স নির্ণয়ের এ কাজটি করে দেয় রেডিও কার্বন ডেটিং। এক কথায় এটি মৃত জীবদেহের বয়স নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি। শুধু মৃত জীবদেহ নয়, কাঠ, কাপড় এসবের বয়সও রেডিও কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়।

কার্বন পরমাণু ও জীবনের অস্তিত্ব

পৃথিবীর জীবজগত প্রধানত চারটি মৌলের ওপর নির্ভরশীল: হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং কার্বন। এদের মধ্যে কার্বনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের উৎপত্তির ক্ষেত্রে কার্বন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কার্বনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একের পর এক কার্বন পরমাণু বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে দীর্ঘ অণু তৈরি করতে পারে। আর এটিই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদার্থের জটিল অণু তৈরি করে দেয়। জীবদেহের ২৫% এর মত কার্বন পরমাণু দ্বারা গঠিত। এই কার্বন পরমাণুই ফসিলের বয়স নির্ধারণে সাহায্য করে।

রেডিও কার্বন

কার্বনের তিনটি আইসোটোপ আছে: কার্বন ১২, কার্বন ১৩ এবং কার্বন ১৪। সবচেয়ে বেশি মাত্রায় রয়েছে কার্বন-১২, তবে খুব সামান্য পরিমাণে কার্বন-১৩ এবং কার্বন-১৪ পরমাণুও রয়েছে। প্রকৃতিতে কিভাবে কার্বন-১৪ পরমাণু তৈরি হচ্ছে আবার ভেঙে যাচ্ছে এবং নির্দিষ্ট অনুপাত বজায় থাকছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে ‘কার্বন-১৪’ নিবন্ধে । কার্বন-১৪ তেজস্ক্রিয় হওয়ায় একে রেডিও (radioactive) কার্বন বলা হয়।

কার্বন চক্র ও কার্বন ডেটিং

বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে উদ্ভিদ বেড়ে ওঠে। প্রাণী সেই উদ্ভিদ খায়। মাংসভোজী প্রাণী তৃণভোজী প্রাণী খায়।কাজেই জীবদেহের কার্বন আসে পরিবেশ থেকে। পরিবেশে যে কার্বন পাওয়া যায় তার নিউক্লিয়াসে ৬টি নিউট্রন ও ৬টি প্রোটন থাকে। এদের বলা হয় কার্বন-১২। যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি কসমিক রশ্মির ক্রিয়ায় প্রকৃতিতে খুব সামান্য পরিমাণে কার্বন ১৪ পরমাণুও থাকে। প্রতি ট্রিলিয়ন কার্বন পরমাণুর মধ্যে একটির মত কার্বন ১৪ পরমাণু থাকে। এই কার্বন-১৪ এর ভর কিছুটা বেশি হলেও রাসায়নিক ধর্ম একই এবং কার্বন ১৪ এর অনুপাত সবসময় একই রকম থাকে। কিন্তু উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত্যুর পর তারা পরিবেশ থেকে আর কার্বন গ্রহণ করে না। কার্বন-১২ পরমাণু স্থায়ী, কিন্তু কার্বন-১৪ অস্থায়ী। এদের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। দিন যত গড়ায় এদের সংখ্যা তত কমে। তাই ফসিলে কার্বন-১৪ এর মাত্রা নিরূপণের মাধ্যমে এরা কত আগে মারা গেছে সেটি জানা যায়।

যে সূত্রের মাধ্যমে বয়স নির্ণয় করা হয়:

t = [ ln (Nf/No) / (-0.693) ] x t1/2

এখানে,

ln ন্যাচারাল লগারিদম,

Nf নমুনায় পাওয়া কার্বন-১৪,

No জীবিত অবস্থায় কার্বন-১৪ এর মাত্রা,

t1/2 কার্বন-১৪ এর অর্ধায়ু।

কার্বন ডেটিং যেখানে অকার্যকর

কার্বন-১৪ পরমাণুর অর্ধায়ু ৫৫৬৮ বছর। অর্ধায়ুর পাঁচ-ছয় গুণ সময় পর কার্বন-১৪ পরমাণুর সংখ্যা এতটাই কমে যায় যে সেটি আর সনাক্ত করা যায় না, তখন রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতি কাজ করে না।

কার্বন ডেটিং পদ্ধতি কেবল জীবদেহের বয়স নির্ণয়ের কাজে ব্যবহার করা যায়। ভূগর্ভে ইউরেনিয়াম বা এধরনের তেজস্ক্রিয় খনির কাছাকাছি এলাকায় তেজস্ক্রিয়তার কারণে এমনিতেই কার্বন-১৪ পরমাণুর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। তাই এসব জায়গায় কয়লা বা হীরায় কার্বন-১৪ এর মাত্রা বেশি দেখা যায়। কেবল ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি এলাকার ফসিলের বয়স নির্ণয়ের কাজেই এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়।

মনে করা হয় ১৯৪০ সালের পর মারা যাওয়া জীবদেহের ক্ষেত্রে রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতি কাজ করবে না। পারমাণবিক চুল্লী এবং বায়ুমণ্ডলে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর কারণে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে যাওয়াই এর কারণ।

বয়স নির্ণয়ের অন্যান্য পরীক্ষা

জীবদেহের ক্ষেত্রে রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতি কাজ করলেও শিলার বয়স নির্ণয়ে এটি অকার্যকর। এছাড়া খুব বেশি পুরনো নমুনার ক্ষেত্রে কার্বন-১৪ পরমাণুর সংখ্যা কমে আসায় বয়স নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। এসব ক্ষেত্রে পটাশিয়াম-৪০, ইউরেনিয়াম-২৩৫, ইউরেনিয়াম-২৩৮, থোরিয়াম-২৩২, রুবিডিয়াম-৮৭ প্রভৃতি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের সাহায্য নেয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email
  • আরও পড়ুন:

  • প্রশ্ন ও উত্তর: