জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে আর এর ফলে বজ্রপাত ঘটাতে সক্ষম মেঘের পরিমাণও বাড়ছে। বিগত বছরগুলোতে সারা পৃথিবীর মত বাংলাদেশেও বজ্রপাতের ঘটনা বেড়েছে। বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কোটিতে ৯ জন। অথচ উন্নত বিশ্বে এই হার কোটিতে ৪ জনের কম। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মাত্র চারদিনে ৮১ জন লোক মারা গিয়েছিল। বাংলাদেশে সাধারণত মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বজ্রঝড় হয়। তবে এপ্রিল, মে এই দু’মাসে বজ্রঝড় এবং বজ্রপাতের ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেশি ঘটে। কিছু সচেতনতা বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পারে।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ওপর নজর রাখুন:
নিয়মিত আবহাওয়ার খবর শুনুন। পত্রিকার পাতায় চোখ রাখুন। বজ্রসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলে খোলা জায়গা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন মানে আপনি বিপদজনক এলাকায় আছেন:
দূরে ঝড় হওয়া এবং বিদ্যুৎ চমকানোর অর্থ এই নয় যে আপনি নিরাপদ স্থানে আছেন। আপনি আপনার অবস্থানে থেকে বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পাওয়া মানেই আপনি বিপদজনক এলাকা বা ডেঞ্জার জোনে আছেন। অনেক সময় ঝড়ের অবস্থান থেকে বেশ দূরে, এমনকি ১০-১৫ মাইল দূরেও বজ্রপাত হয়। আবার বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেও বজ্রপাত হতে পারে।
নিরাপদ আশ্রয় হল পাকাবাড়ি:
বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা বিপদজনক। দ্রুত মজবুত পাকাবাড়িতে আশ্রয় নিন। এটিই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। পাকাবাড়ি না পেলে যেকোনো বাড়িতেই আশ্রয় নিন।
গাড়িও নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে:
কাছাকাছি পাকাবাড়ি না পেলে মজবুত ধাতব ছাদ আছে এমন গাড়িতেও আশ্রয় নিতে পারেন।
রাবারের টায়ার নিয়ে ভুল ধারণা:
অনেকে ভাবেন, গাড়ির টায়ার রাবারের তৈরি, রাবার বিদ্যুৎ অপরিবাহী তাই বজ্রপাতের সময় গাড়িতে বসে থাকা নিরাপদ। এ ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। বজ্রপাতের উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎপ্রবাহে রাবারের টায়ার কোন বাধাই তৈরি করে না। বরং উত্তম পরিবাহীর মত আচরণ করে।
আসলে গাড়ির ধাতব কাঠামো ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী হওয়ায় এটি ফ্যারাডের খাঁচার (Faraday cage) মত কাজ করে। বিদ্যুৎ গাড়ির কাঠামো এবং রাবারের টায়ার হয়ে মাটিতে পৌঁছে যায় ফলে গাড়ির ভেতরে থাকা ব্যক্তি নিরাপদে থাকেন।
বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে থাকলে:
যতদ্রুত সম্ভব নিরাপদ ছাউনির নিচে গাড়ি নিয়ে যান। সেটি সম্ভব না হলে অবশ্যই গাড়ির জানালা বন্ধ রাখুন, কাচ এবং গাড়ির ধাতব কাঠামো স্পর্শ করবেন না। কারণ বজ্রপাতের সময় গাড়ির ধাতব কাঠামো এবং জানালার কাচ দু’টোই বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।
যদি খোলা জায়গায় থাকতেই হয়:
বজ্রপাতে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া। উঁচু গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, যাত্রী ছাউনি ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন। এসব জায়গায় বজ্রপাত হওয়ার আশংকা বেশি থাকে। এমনকি উঁচু বেড়া, কাপড় শুকোতে দেয়ার তার, বিদ্যুতের তার এসব থেকেও দূরে থাকুন। গাছের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরাও আহত হতে পারেন। বিশেষজ্ঞগণ গাছের উচ্চতার দ্বিগুণ দূরত্বে কিংবা কমপক্ষে ৪ মিটার দূরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। এমনকি তাঁবুও নিরাপদ নয়। বিশেষ করে তাঁবুর ফ্রেম ধাতুর তৈরি হলে তা আরও বিপদজনক।
উঁচু জায়গায় না দাঁড়িয়ে নিচু জায়গায় থাকুন। দাঁড়িয়ে না থেকে নিচু হয়ে যতটা সম্ভব গুটিয়ে মাটির কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন। একই সাথে মাটির সাথে যতটা সম্ভব কম স্পর্শ রেখে দু’পায়ের ওপর ভর দিয়ে থাকুন। মাটিতে শুয়ে পরা ঠিক হবে না। বজ্রপাত হলে বজ্রবিদ্যুৎ মাটির উপরিভাগে দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শুয়ে থাকলে আপনিও তড়িতাহত হতে পারেন।
কানে হেডফোন বা কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্র থাকলে খুলে ফেলুন। এগুলো বজ্রপাত আঘাত হানলে ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। আপনার পিঠে থাকা ব্যাগে ধাতুর ফ্রেম থাকলে সেটিও বিপদ ডেকে আনতে পারে। এরকম ব্যাগ থাকলে সেটি নামিয়ে রেখে দূরে অবস্থান নিন।
কয়েকজন থাকলে সবাই এক জায়গায় না থেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে অবস্থান নিন। প্রতিটি বজ্রপাতের পর দেখুন সবাই ঠিক আছে কিনা। কেউ আহত হয়ে থাকলে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারলে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
জলাশয় থেকে দূরে থাকুন
বজ্রপাতে সাধারণত মাছ মারা যায় না। এর অর্থ এই নয় যে বজ্রপাতের সময় জলাশয়ে থাকা নিরাপদ। আসলে মাছেরা সাধারণত পানির উপরিভাগে থাকে না। তাই বজ্রপাতে মাছের মৃত্যুর কথা শোনা যায় না। কিন্তু মানুষ পানির উপরিভাগে সাঁতার কাটে, পানি বেশ ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী, এক জায়গায় বজ্রপাত হলে বহুদূর পর্যন্ত বৈদ্যুতিক বিভব ছড়িয়ে পড়ে। তাই পানিতে থাকা অবস্থায় মানুষের আহত হওয়ার আশংকা অনেক বেশি।
নৌকায় থাকলে
নৌকার ছৈয়ের নিচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে, নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। নৌকার পাটাতনে যতটা সম্ভব কম স্পর্শ রেখে বসে থাকতে হবে।
রাস্তায় জমে থাকা পানিও বিপদজনক হতে পারে
ঝড়ের ফলে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে রাস্তায় জমে থাকা পানির ওপর পড়তে পারে। আর সেই পানিতে পা পড়লে যে কেউ তড়িতাহত হতে পারে। আবার কাছাকাছি পানিতে বাজ পড়লেও তড়িতাহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
খালি পায়ে থাকা কিংবা ভেজা চামড়ার জুতো বিপদজনক
বজ্রপাতের সময় খালি পায়ে কিংবা ভেজা চামড়ার জুতো পায়ে থাকা বিপদজনক। রাবারের গামবুট কিছুটা নিরাপত্তা দিতে পারে। অবশ্য সরাসরি বাজ পড়লে রাবারের বুট কোন কাজে আসবে না।
পরের পাতায় দেখুন: বজ্রপাতের সময় বাড়ির ভেতরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।