জলবিদ্যুৎ বা পানিবিদ্যুৎ

শিহাব উদ্দিন আহমেদ | মার্চ ২৮, ২০১২

dam photoবর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার মূলে রয়েছে শক্তির ব্যবহার। আদিকালে মানুষ পেশীশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। পরবর্তীকালে মানুষ পশুশক্তিকে বশে এনে কাজে লাগালো। কিন্তু মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতির সূত্রপাত জড়শক্তির ব্যবহার আয়ত্ত করার পর থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশে কয়লা ও খনিজ তেলের আবিষ্কারের পর থেকে জড়শক্তির ব্যবহার শুরু হয়। যদিও মানুষ বহু প্রাচীনকাল থেকে কাঠ পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করছে,বাতাস বা পানির গতির সাহায্যে শস্য ভাঙানোর কাজ করছে।

শক্তি সম্পদরুপে কয়লা ও খনিজ তেলের পরেই জলবিদ্যুতের স্থান। পৃথিবীতে সম্ভাব্য জলবিদ্যুৎ শক্তির (Potential Water Power Resource) পরিমাণ অনেক বেশি। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় অপেক্ষা অনেক কম। সে কারণে জলবিদ্যুতের ব্যবহার বিভিন্ন দেশে,বিশেষতঃ উন্নয়নশীল দেশে এখনও বিশেষ প্রসার লাভ করেনি। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে,নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রন জলসেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন, ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়।

বিশ্বব্যাপী স্থাপিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৪০ভাগ উৎপাদন করে এবং প্রায় ১০০ কোটি মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বিশ্বে সর্বমোট ৬৭৫,০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়,যা ৩.৬ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের সমান। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ২০০০ এর বেশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট আছে, জলবিদ্যুৎ দেশটির সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য শক্তি।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ জলশক্তি ব্যবহার করে আসছে। মিশরীয়রা বহু আগেই পানির সাহায্যে চাকা (Water-wheel) ঘুরানোর কৌশল জানত। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের বহু আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে পানি প্রবাহের গতির সাহায়্যে চাকা ঘুরিয়ে ময়দাকল, কাঠচেরাই কল ইত্যাদি চালান হত। হিমালয়ের কোন কোন স্থানে এখনও পানির সাহায়্যে চাকা ঘুরিয়ে গম জোয়ার, বাজরা প্রভৃতি শস্য ভাঙানো হয়। এগুলোকে ‘পানি চাক্কি’ বলে। ২০০০ বছর আগে গ্রীকরা গম থেকে আটা তৈরির কাজে পানি চাক্কি ব্যবহার করত বলে জানা যায়। সে পানি চাক্কি অনেকটা এখনকার টার্বাইনের মতই। চাকার গিয়ার গম ভাঙার কাজটি করত। রোমেও জলপ্রবাহের শক্তি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু সহজলভ্য দাস আর পশু শক্তির কারণে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এর ব্যবহার বিস্তার লাভ করেনি। মধ্যযুগে বড় কাঠের পানি চাক্কি তৈরি হয়। যা থেকে প্রাপ্ত শক্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ অশ্বশক্তি বা হর্স পাওয়ার।

1মূলনীতি

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকৃতির পানি চক্রকে ব্যবহার করে। হিমবাহ, বৃষ্টি, বাষ্প প্রভৃতি অবস্থায় পানি থাকতে পারে। সূর্যের আলোর উত্তাপে বায়ু প্রবাহ সৃষ্টি হয়। কারণ উত্তপ্ত হালকা বায়ু উপরে উঠে গেলে শূন্যস্থান পূরণ করতে সেখানে তুলনামূলকভাবে ভারী শীতল বায়ু চলে আসে। বায়ু প্রবাহ সমুদ্র ও জলাশয়ে পানির বাষ্পীভবন ঘটায় বা ত্বরান্বিত করে। মেঘের সৃষ্টি হয়। আর মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। যা নদীতে পানি প্রবাহের যোগান দেয়। অবশ্য বরফ গলা নদীও হতে পারে। তবে সেটাও পানি চক্রের অংশ। বৃষ্টিপাত অস্বাভাবিকভাবে কমলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

নদীর পানি প্রবাহের যে কি বিপুল শক্তি তা এমনিতে অনুমান করা কঠিন। কিন্ত এ পানি যখন একটি সংকীর্ণ পথে প্রবাহিত হয় বা প্রবাহিত করা করা হয় তখন এর শক্তির বিষটি বোঝা যায়।

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এ শক্তিকে কিছু সহজ সরল যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরিত করে। এখানে স্থৈতিক শক্তিকে প্রথমে যান্ত্রিক শক্তিতে, তার পরে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরিত করা হয়। জোয়ার ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র মূলত একটি বড় পানি চাক্কি বা water wheel । এর মূল কথা হচ্ছে বাঁধের মধ্য দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয় তা টার্বাইনকে ঘোরায় আর টার্বাইন জেনারেটর ঘোরায়।

পরবর্তীকালে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন শক্তির উৎস হিসেবে পানির ভূমিকাকে যথেষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। যে সব আবিষ্কার জলপ্রবাহের শক্তিকে জলবিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরিত করতে সাহায্য করে সেগুলো হল:

জল টারবাইনের (Hydro or Water Turbine) উদ্ভাবন- এটি একটি উন্নত ধরনের জল চক্র বা পানি চাক্কি, যা উঁচু বাঁধের উপর থেকে পতিত জলপ্রবাহের শক্তিতে ঘুরে থাকে।

ডায়নামো বা জেনারেটর উদ্ভাবন- পানিবিদ্যুৎ এর ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য বৈদ্যুতিক জেনারেটর উদ্ভাবন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। যা দ্রুত ঘূর্ণায়মান টার্বাইনের সাহায্যে চালিত হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

সিমেন্টের ব্যবহার- যার ফলে নদীর উপর সুউচ্চ কংক্রিটের বাঁধ নির্মণ সম্ভব হয়েছে, ফলশ্রুতিতে বাঁধের পেছনে বিশাল জলাধার সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
  • আরও পড়ুন:

  • প্রশ্ন ও উত্তর: