সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৩ জুলাই, ১৮৮০ – ১৭ জুলাই, ১৯৩১) ছিলেন সাহিত্যিক, সুবক্তা এবং একজন কৃষকনেতা। বিংশ শতকের শুরুতে পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং জাগরণের জন্য কাজ করলেও তিনি ছিলেন মনে প্রাণে অসাম্প্রদায়িক। তিনি মনে করতেন সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমেই হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব আর এর মাধ্যমে ব্রিটিশদের হটাতে হবে।
ইসমাইল হোসেন সিরাজীর জন্ম হয়েছিল সে সময়কার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পূর্ববঙ্গে সিরাজগঞ্জ মহকুমা বা আজকের বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলায়। নিজ জেলার নাম থেকেই ‘সিরাজী’ উপাধি যোগ করে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর বাবা আব্দুল রহিম খন্দকার ছিলেন ইউনানি বা মুসলিম রীতি অনুসরণে প্রচলিত ভেষজ চিকিৎসক। বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় ইসমাইল হোসেন সিরাজীর পক্ষে কলেজে পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মেধাবী সিরাজী ঠিকই নিজেকে তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। শৈশবে স্কুলে ফার্সি শেখেন আর বাড়িতে শেখেন সংস্কৃত। সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং সাহিত্যে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। হিন্দুশাস্ত্রের বেদ, মনুসংহিতা এবং উপনিষদের মত গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেছিলেন তিনি।
অনেকগুলো সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছেন সিরাজী। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, আঞ্জুমান-ই-উলামা-ই-বাঙ্গালা, জামিয়াত-ই-উলামা-ই-হিন্দ, স্বরাজ পার্টি এবং কৃষক সমিতি। তিনি জমিদার এবং মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কৃষকদের সংগঠিত করেন, সিরাজগঞ্জের কৃষক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
সে সময় বঙ্কিম চন্দ্রের মত অনেক বিখ্যাত লেখকের সাম্প্রদায়িক লেখা মুসলিম সমাজকে আক্রমণ করে। রমেশচন্দ্রের মত লেখকের চোখে এসব লেখা ছিল মিথ্যার আচ্ছাদনে ঐতিহাসিক সত্য পরিবেশন। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলার মুসলিম সমাজের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন ইসমাইল হোসেন। তাঁর লেখনীতেই জবাব খুঁজে পেয়েছিল সে সময়কার মুসলিম সমাজ। সত্যের বিকৃতির বিরুদ্ধে লড়তে তিনি লিখেছেন ‘স্পেন বিজয় কাব্য’ এবং ‘তারাবাঈ’ ও ‘নুরুদ্দিন’ এর মত উপন্যাস।
উনিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনল প্রবাহ’ বের হয়। এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় এবং জেল খাটতে হয়।
সেসময়কার মুসলিম সমাজে চিন্তার দৈন্য এবং কর্মবিমূখতা ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছিল ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে। শিবলী নোমানী এবং মুহম্মদ ইকবালের মত সিরাজীও মনে করেছিলেন ধর্মীয় এবং সেক্যুলার চিন্তার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমানদের জাগিয়ে তোলা সম্ভব আবার একই সাথে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নয়নও ঘটানো সম্ভব। সেসময়কার আল-এসলাম, ইসলাম প্রচারক, প্রবাসী, প্রচারক, কোহিনূর, সোলতান, মোহাম্মদী, সওগাত, নবযুগ, নবনূর প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে ইসলামের গৌরবময় অতীত এবং ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তিনি একই সাথে সত্যিকার ইসলামী শিক্ষা এবং আধুনিক শিক্ষার পক্ষে কথা বলেছেন।
সিরাজী ছিলেন বাগ্মী বক্তা। পশ্চিমা দুনিয়ায় মার্ক টোয়েন, বেকন কিংবা বার্কের মত বক্তারা বক্তৃতা দিয়ে যেভাবে সুনাম এবং অর্থ কামিয়েছেন, ইসমাইল হোসেনকে তার সাথে তুলনা করা যায়। বেকনের বক্তৃতার সময় শ্রোতারা পারলে হাঁচি-কাশিও আটকানোর চেষ্টা করতেন যাতে কোন বাক্য বা কয়েকটি শব্দ শোনা থেকে বঞ্চিত না হন। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে এসে শ্রোতারা চাইতেন বক্তৃতা যেন শেষ না হয়। ইসমাইল হোসেন সিরাজীও অনেকটা সেভাবে প্রভাব ফেলতেন তাঁর শ্রোতাদের ওপর। সিরাজীর একটি সভায় বক্তৃতার বিবরণ পাওয়া যায় প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর লেখায়। তিনি লেখেন, “অমন ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা তার আগে আর কখনো শুনি নাই। তখন আমাদের চোখে আজাদীর স্বপনের আবেশ, আমাদের তরুণচিত্ত তখন দাউ দাউ শিখায় জ্বলে উঠতে উন্মুখ। সেই পরিবেশে তাঁর সেদিনের বক্তৃতা শ্রোতাদের মনে আগুন লাগিয়ে দিল। তার কণ্ঠ উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়ে ওঠে; আমি রুদ্ধ নি:শ্বাসে শুনি। তারপর উচ্চতম গুরু গর্জনে আসে তাঁর চরম আদেশ ওঠ, ওঠ, ওঠ। সে আহবানে ঘন ঘন শরীর শিউরে ওঠে, মনে হয় তখনি লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়াই।”
এরকম বক্তা হওয়ার জন্য প্রাচীন গ্রীসে ডেমোসথেনিস বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতেন। ইসমাইল হোসেনের অনুশীলনও ছিল অনেকটা একই রকম। শৈশবে তিনি নিজের কক্ষে দাঁড়িয়ে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বইগুলোর উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতেন।
ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সভা পণ্ড করার জন্য বহুবার ১৪৪ ধারা জারি করেছে ব্রিটিশ সরকার। তাঁর বাগ্মীতার আরেক গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে মনি অর্ডারে দশ টাকা পাঠিয়েছিলেন সিরাজী। আর তাতে লিখেছিলেন, “পড়িয়া সুখী হইয়া দশটা টাকা পাঠাইলাম। ফিরাইয়া দিও না, ব্যথা পাইব। আমার থাকিলে দশ হাজার টাকা পাঠাইতাম।”
১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, “ টাকা দশটা লইয়া মাথায় ঠেকাইলাম। তখনো আমি তাঁহাকে দেখি নাই। কাঙাল ভক্তের মত দূর হইতেই তাঁহার লেখা পড়িয়াছি, মুখস্থ করিয়াছি, শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি। সেই দিন প্রথম মানস নেত্রে কবির স্নেহ উজ্জ্বল মূর্তি মনে মনে রচনা করিলাম, গলায়, গায়ে ফুলের মালা পরাইলাম। তাহার ফরিদপুর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে তাঁহার জ্যোতির্বিমন্ডিত মূর্তি দেখিলাম। দুই হাতে তাঁহার পায়ের তলার ধূলি কুড়াইয়া মাথায়, মুখে মাখিলাম। তিনি আমায় একেবারে বুকের ভিতর টানিয়া লইলেন, নিজ হাতে করিয়া মিষ্টি খাওয়াইয়া দিতে লাগিলেন। যেন বহুকাল পরে পিতা তাহার হারানো পুত্রকে ফিরিয়া পাইয়াছে। আজ সিরাজগঞ্জে আসিয়া বাঙলার সেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মনস্বী দেশপ্রেমিকের কথাই বারে বারে মনে হইতেছে। এ যেন হজ্জ করিতে আসিয়া কাবা শরীফ না দেখিয়া ফিরিয়া যাওয়া।”
আরও জীবনী: