মোহাম্মদ লুৎফর রহমান (১৮৮৯-১৯৩৬) ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, সম্পাদক, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং সমাজকর্মী। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অর্জন আহামরি কিছু না হলেও মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছেন। ডাক্তার মোহাম্মদ লুৎফর রহমান নামেই মানুষের কাছে বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি, পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করেও জাতির পশ্চাৎপদতা দূর করার জন্য লড়ে গেছেন। তাকে নিজের দারিদ্রের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে এমনকি অনাহারেও কাটাতে হয়েছে। আর মাত্র ৪৭ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা
ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার অন্তর্গত (আজকের বাংলাদেশের মাগুরা জেলা) পরনান্দুয়ালী গ্রামে ১৮৮৯ সালে এক সচ্ছল মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল মাগুরা মহকুমার হাজীপুর গ্রামে। বাবার নাম ময়নুদ্দিন যোয়ারদার এবং মায়ের নাম শামসুন নাহার। লুৎফর রহমানের বাবা ছিলেন স্টেশন মাস্টার। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে তার যথেষ্ট পাণ্ডিত্য ছিল যা লুৎফর রহমানকেও প্রভাবিত করেছিল।
হাজীপুর গ্রামের মাইনর স্কুলে পড়াশোনার পর মাগুরা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে (আজকের মাগুরা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) এবং তারপর হুগলী হাই ইংলিশ স্কুলে পড়েন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে বৃত্তিসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় (এসময়ের এসএসসি) পাশ করেন। এরপর কোলকাতার হুগলী মহসিন কলেজে এফ. এ. (এসময়ের এইচএসসি) শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখানকার টেইলার হোস্টেলে থাকতেন তিনি। এসময় তিনি পাঠ্য বহির্ভূত বিষয়ে বেশী আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
বাবার সাথে মনোমালিন্য
কলকাতায় যে টেইলার হোস্টেলে লুৎফর রহমান থাকতেন তার কাছেই ইন্টালী বাজারে খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি গির্জা ছিল। সেখানকার পাঠাগার ও অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন তিনি। শোনা যায় তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে চেয়েছিলেন। অবশ্য অনেক জীবনীকার এ তথ্যের সাথে একমত নন। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় খ্রিস্টধর্ম লুৎফর রহমানকে আকর্ষণ না করলেও খ্রিস্টান পাদ্রীরা যেভাবে সৎকাজে অনুপ্রেরণা দেয়ার মাধ্যমে মানুষের নৈতিক চরিত্রকে উন্নত করার চেষ্টা চালাতো, যেভাবে আন্তরিকতার সাথে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করতো তা লুৎফর রহমানকে মুগ্ধ করেছিল। এভাবেই তিনি পরাধীন দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু লুৎফর রহমানের বাবা ময়নুদ্দিন যোয়ারদার স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তার চেয়েও বড় কিছু হবে। এদিকে লুৎফর রহমান নিজ গ্রামের হাজীপুরের আয়শা খাতুনকে বিয়ে করেন। আয়শা খাতুনের বাবা মোহাম্মদ বদরউদ্দীন ছিলেন মুন্সীগঞ্জ রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক। লুৎফর রহমানের স্টেশন মাস্টার বাবা বিনা অনুমতিতে তুলনামূলকভাবে দরিদ্র পরিবারে ছেলের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি এবং ছেলের সব ধরনের আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেন। এর জেরে লুৎফর রহমান পড়াশোনা ছেড়ে কোলকাতা থেকে চলে আসেন শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী জীবন।
‘নারী তীর্থ’ ও ‘নারী শিল্প শিক্ষালয়’
নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল দূরে ‘নারী তীর্থ’ ও ‘নারী শিল্প শিক্ষালয়’ নামে দু’টি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছিলেন লুৎফর রহমান। এটি ছিল পতিতা বা নারী যৌনকর্মীদের আলোর পথে নিয়ে আসার একটি প্রয়াস। সেসময় ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে অল্প বয়সী দরিদ্র মেয়েদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে কলকাতায় এনে দেহব্যবসায় বাধ্য করা হত। এদেরকেই অন্ধকার জীবন থেকে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসিত করতে চেয়েছিলেন লুৎফর রহমান। পরে কোলকাতাতেও এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। কোলকাতায় লুৎফর রহমানের গড়ে তোলা ‘নারী তীর্থ’ সংগঠনের কার্যনির্বাহক কমিটির সভাপতি ছিলেন বেগম রোকেয়া। বিখ্যাত কথাশিল্পী আবুল কালাম শামসুদ্দীন লেখেন: “লুৎফর রহমান পতিতা নারীদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য ৫১নং মির্জাপুর স্ট্রিটে ‘নারীশিল্প বিদ্যালয়’ খুলেছিলেন। একজন দর্জি রেখে তিনি তাদের পোশাক তৈরি শেখাতেন। পোশাক তৈরি ছাড়াও চরকায় সুতা-কাটা ও বই বাঁধার কাজ শেখার ব্যবস্থাও করেছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে তিনি এই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি।”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলামের মত বিখ্যাত অনেক বাংলা সাহিত্যিক এসব নারীদের দুর্দশা নিয়ে লিখলেও প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করার উদ্যোগ নিতে পারেননি। ডা: লুৎফর রহমান নিজে উদ্যোগ নিয়ে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সংগঠন দু’টি বন্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি আক্ষেপ করে লেখেন: “কলকাতায় বিভিন্ন জেলা হইতে যুবতী মেয়েদিগকে লইয়া বেশ্যাবৃত্তি করান হয়; তাহাদের জীবন চিরদিনের জন্য চির অন্ধকার হইয়া যায়। ইহারা অতিশয় দুর্মতি, হীনা, পিশাচীর জীবনযাপন করে। আমি ইহাদিগকে সুপবিত্র জীবনে ফিরাইয়া আনিয়া উপার্জনশীলা ও বিবাহিত করার উদ্দেশে একটি নারীশিল্প বিদ্যালয় বহুদিন চালইয়াছিলাম। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়াও মুসলমানের কাছে একটি টাকা পাওয়া যাইত না। সে কোথা হইতে দিবে? মুসলমানের ঘরে টাকা নাই। চৌকিদারি, পেয়াদাগিরি, চুরি করিয়া, ঘুষ খাইয়া, ছ্যাচরামি করিয়া ২/১ টাকা যা সে সংগ্রহ করে তাহা দিয়া সে পরিবার প্রতিপালন করিতে পারে না। সে কি ছাই ধর্ম পালন করিবে-কি দান করিবে? তাহার কি আছে? সমাজের ভয়ে ঋণ করিয়া সে মিথ্যাই বাপ-মায়ের ফাতেহা করে মাত্র। ---কাজেই আমার প্রতিষ্ঠান আমি রক্ষা করিতে পারিলাম না।”
লেখক জীবন
এদিকে সৈয়দ নওশের আলীর ‘সহচর’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ‘মোয়াজ্জিন’ নামে অপর একটি পত্রিকায় কাজ করতে শুরু করেন। বস্তুত পত্রিকাগুলো ছিল তাঁর সমাজ পরিবর্তন আন্দোলনের হাতিয়ার। কিন্তু বাবার আর্থিক সাহায্য বন্ধ হওয়ার পর এসবে আর চলছিল না।
শিক্ষকতা এবং মুসলিম হিসেবে তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া
আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করতে পাবনার সিরাজগঞ্জ মহকুমার (আজকের সিরাজগঞ্জ জেলা) ভিক্টোরিয়া স্কুলে অ্যাংলো-পারসিয়ান শিক্ষক পদে যোগ দেন। শিক্ষক লুৎফর রহমানের মধ্যে কঠোর নৈতিকতা চর্চা লক্ষ্য করা যায়। একবার স্কুলের হেড মৌলভী সাহেব তার এক উর্দুভাষী বন্ধুর সাথে লুৎফর রহমানের পরিচয় করিয়ে দেন। সে যুগে শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে উর্দু এবং ফার্সি ভাষার যথেষ্ট চর্চা ছিল। লুৎফর রহমানও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। হেড মৌলভী সাহেব তার বন্ধুর সাথে আলাপচারিতায় উর্দু ভাষা ব্যবহার করলেও লুৎফর রহমান বাংলায় কথা বলেন কারণ তিনি জানতের মৌলভী সাহেবের সেই বন্ধু উর্দুভাষী হলেও বাংলা বুঝতেন।
লুৎফর রহমানের চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভিক্টোরিয়া স্কুলের এক ঘটনায়। একদিন স্কুলের এক মুসলমান ছাত্রের কাছে পানি খেতে চেয়েছিলেন লুৎফর রহমান। সে সময় স্কুলে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের জন্য আলাদা কলসীতে পানি রাখা হত। মুসলমানদের কলসীতে পানি না থাকায় ছাত্রটি হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত কলসী থেকে পানি এনে দেয়। এটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে একটি সভা ডাকা হয়। পরিস্থিতি সামলাতে প্রধান শিক্ষক কলসীর পানি ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেন।
সে যুগের মুসলমান ছাত্ররা এটিকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিলেও লুৎফর রহমানের দৃষ্টিতে এটি ছিল মানবতার অপমান। প্রতিবাদ হিসেবে চাকুরী ছেড়ে চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ হাই স্কুলে যোগ দেন।
চিকিৎসক ও সাহিত্যিক জীবন
অচিরেই লুৎফর রহমান বুঝতে পারেন পশ্চাৎপদ জাতির অবস্থা পরিবর্তনের যে আন্দোলন তিনি করছেন তাতে অন্যদের সমর্থন এবং অর্থ প্রয়োজন। এজন্য আবার কোলকাতায় ফেরেন তিনি। সেখানি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। এসময়ই নামের সাথে ‘ডাক্তার’ শব্দটি ব্যবহার শুরু করেন। কিন্তু এখানেও সমাজসেবার কাজেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। নামেমাত্র ফি নিয়ে মানুষের চিকিৎসা দিতে থাকেন ফলে অভাব অনটন লেগেই থাকে।
এতকিছুর মধ্যেও তাঁর সাহিত্য সাধনা চলতে থাকে। কবি গোলাম মোস্তফা, মুহম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর মত বিখ্যাত সাহিত্যিকদের নজর কেড়েছিলেন তিনি। তাঁর লেখা মানুষকে জীবন গঠনের অনুপ্রেরণা যোগায়। তাঁর বেশির ভাগ লেখাই জীবদ্দশায় প্রকাশিত হতে পারেনি। সওগাত, প্রবাসী, হিতবাদী, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, মোসলেম ভারত, সাধনা, সোলতান, সহচর, সাম্যবাদী, সাহিত্যিক, মোয়াজ্জিন এবং মাসিক মোহাম্মদী এর মত বিখ্যাত পত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হত। ছোটগল্প, কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ ইত্যাদির পাশাপাশি অনুবাদ গ্রন্থও রয়েছে তাঁর। এছাড়া শিশুতোষ সাহিত্যও রচনা করেছেন।
সুযোগ পেলেই মানুষের সেবায় এগিয়ে যেতেন তিনি। অনেকে মনে করেন এটিই হয়তো মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর কারণ। লুৎফর রহমান অজ্ঞাত এক যক্ষ্মা রোগীর শুশ্রূষা করতে গিয়ে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এবং সুচিকিৎসার অভাবে মারা যান।
আরও দেখুন: মোহাম্মদ লুৎফর রহমান এর বিখ্যাত উক্তিগুলো
আরও জীবনী: