যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী এর জীবনী (Biography of Jadav Chandra Chakravarti in Bangla) | পড়ার টেবিল থেকে

যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী Photo

যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী

(Jadav Chandra Chakravarti)


যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী [জন্ম: ১৮৫৫ – মৃত্যু: ২০ নভেম্বর, ১৯২০] ছিলেন একজন বাঙালি গণিতবিদ এবং গণিতের শিক্ষক। তিনি ছিলেন এম.এ.ও. কলেজে (মোহামেডান এংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ) গণিতের অধ্যাপক। স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটিই ১৯২০ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল।

যাদব চন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা পাটীগণিত, বীজগণিত এবং জ্যামিতি বই ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে পুরো উপমহাদেশে পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যে গণিতকে সাধারণত কঠিন একটি শাস্ত্র হিসেবে মনে করা হয় সেই গণিতকেই তিনি অত্যন্ত সহজভাবে শিক্ষার্থীদের সামনে নানা উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘পাটীগণিত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯০ সালে। তখন থেকেই এটি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে চিরাচরিত রীতি ভেঙে ভিন্নভাবে সহজ-ভাষায় পাটীগণিতকে উপস্থাপন করেছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই বইটি পছন্দ করেছিল। ১০০ টির বেশি পুনর্মুদ্রণ বের হয়েছিল বইটির, আর এটিই প্রমাণ করে বইটি কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল। বইটি বাংলা, অসমীয়া, উড়িয়া, নেপালি, হিন্দিসহ উপমহাদেশের অনেকগুলো ভাষায় অনুদিত হয়। বইটিতে কিছু মজার প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন তিনি, যার মধ্যে রয়েছে শুভঙ্করের নিয়ম, বছরের কোন নির্দিষ্ট দিন কি বার হবে সেটি বের করা ইত্যাদি। তাঁর দেয়া পদ্ধতি অনুসরণ করে ইতিহাসের কোন গুরুত্বপূর্ণ দিন কি বার ছিল সেটিও বের করে ফেলা যায়। গণিতশাস্ত্রে অসামান্য দক্ষতার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে “গণিত সম্রাট” উপাধি দিয়েছিল।

ভারতীয় গণিতবিদদের অদ্ভুত একটি দিক হচ্ছে উচ্চতর গণিতে যাদের বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল না তারাই আবার এমন সব গাণিতিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিভাবান গণিতবিদগণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আজ যে দশমিক সংখ্যা-পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করছি তা ছাড়া গণিতশাস্ত্রের কোন অগ্রগতিই সম্ভব ছিল না। এই দশমিক পদ্ধতির জন্ম হয়েছিল কোন এক নাম না জানা ভারতীয় গণিতবিদের হাতে। যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন এমনই একজন গণিতবিদ।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

১৮৫৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে বাংলায় পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার কামারখন্দের তেতুঁলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন (আজকের বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলা)। তার বাবার নাম কৃষ্ণ চন্দ্র চক্রবর্তী ও মা দুর্গা সুন্দরী। বাবা ছিলেন একজন পুরোহিত যার আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। বাল্যকালেই বাবাকে হারিয়েছিলেন চক্রবর্তী।

নিজ গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৮৭৬ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করে মাসিক ১৫ টাকা বৃত্তি পান। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কোলকাতা যান। কোলকাতায় জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিটিউশনে (এখনকার স্কটিশ চার্চ কলেজ) ভর্তি হন। সেখানে বৃত্তির টাকা থেকে মা’কে প্রতি মাসে ৫ টাকা করে পাঠাতেন। বাকি ১০ টাকা থাকা-খাওয়া, পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। খরচ যোগাতে ছাত্র পড়ানো শুরু করেন।

তাঁর যাদব চন্দ্র হয়ে ওঠার পেছনে শিক্ষক গৌরিশঙ্কর দে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বাবার মত ছায়া হয়ে আগলে রেখেছিলেন ছাত্রকে।

প্রথম বিভাগে এফএ পাশ করার পর যাদব চন্দ্রের বৃত্তি বেড়ে হয় ২৫ টাকা। শোনা যায় এ বৃত্তি পাওয়ার শর্ত ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়া। সেখানে পড়াশোনার অনেক খরচ। প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে ভর্তি হন আর পড়াশোনার খরচ যোগাতে সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞান পড়াতে শুরু করেন।

কর্মজীবন

পড়াশোনা শেষে কলকাতা সিটি কলেজে গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন কোচবিহারে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

ভারতের পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে এম,এ,ও কলেজ (মোহামেডান এংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুরুর বছরগুলোতে ইংল্যান্ড থেকে আসা নামী শিক্ষকগণ উচ্চ বেতনে সেখানকার গণিত বিভাগে কাজ করেছেন। ১৮৮৮ সালে তুলনামূলক কম বেতনে যোগ দেন যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী। কোলকাতার একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। সে সময় বাঙালী বিদ্বেষী একটি পরিবেশ ছিল এম,এ,ও কলেজে। সে সময় বাঙালী রাজনৈতিকরা আলীগড়ে তাচ্ছিল্যের শিকার হতেন।

যাদব চন্দ্র চক্রবর্তীর সহকর্মী মরিসন মন্তব্য করেন, যাদব চন্দ্র নিজেও বিরূপ আচরণে শিকার হয়েছেন সে সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু মুসলিম সমাজের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার যে লক্ষ্যে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সাথে নিজেকে একাত্ম করে নিয়েছিলেন যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী।

নৈতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি লালনকে সব সময়ই কলেজটিতে গুরুত্ব দেয়া হত। যাদব চন্দ্র একবার মন্তব্য করেছিলেন যতক্ষণ কলেজের স্বার্থ জড়িত ততক্ষণ আমি আন্তরিকভাবে মুসলিম। শুরুর বছরগুলোতে আরবি আর ফার্সি বাদে অন্যসব বিষয়ের ক্লাসও তাঁকে নিতে হয়েছে। এতে তাঁর সহকর্মী ছিলেন সিডনস। ২০০ রুপি বেতনে শুরু করার ১৭ বছর পর ১৯০৫ সালে তাঁর বেতন বাড়িয়ে ৩০০ রুপি করা হয়। ততদিনে অবশ্য তিনি জনপ্রিয় পাঠ্যবইগুলোর রয়্যালটি বাবদ বেশ অর্থ পেতে শুরু করেছেন।

জ্ঞানের গভীরতা, রসবোধ, মানবিকতা, ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম আর সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের প্রতি সহমর্মিতার জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীরা তাঁকে ডাকতো বাবু সাহেব বলে।

১৯১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেন তিনি। সেদিনের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে কলেজের ট্রাস্টিদের পক্ষ থেকে স্বর্ণের ঘড়ি উপহার দেয়া হয় আর শিক্ষার্থীরা উপহার দেয় রুপার ‘টি-সেট’। সেদিনই চালু হয় গণিতে ‘চক্রবর্তী পদক’।

শেষজীবন

১৯০১ সালে নিজ শহর সিরাজগঞ্জে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৬ সালে অবসরের পর সিরাজগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯২০ সালের ২৬ নভেম্বর মারা যান তিনি।

আরও জীবনী: