গোলাম মোহাম্মদ বখশ বাট (Ghulam Mohammad Baksh Butt) [জন্ম: ২২ মে ১৮৭৮ - মৃত্যু: ২৩ মে, ১৯৬০] ছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগির যিনি গামা পালোয়ান নামেই উপমহাদেশে বেশি পরিচিত। ৫২ বছরের বেশি দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কখনো হারেননি তিনি আর এজন্যই তিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন রুস্তম-ই-জামানা হিসেবে। রুস্তম-ই-হিন্দ নামেও পরিচিতি ছিল তাঁর। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কুস্তিগিরদের একজন হিসেবে দেখা হয় গোলাম মোহাম্মদ বখশ বাট বা গামা পালোয়ানকে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের স্ত্রী কুলসুম নেওয়াজ এই বিখ্যাত কুস্তিগিরের নাতনী।
শৈশব
১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবে অমৃতসরের জাবোয়াল গ্রামের এক কাশ্মীরি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন গামা পালোয়ান। পেশাদার কুস্তি লড়ার একটি পারিবারিক ঐতিহ্য আগে থেকেই ছিল। ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর নানা তাঁর দেখাশোনা করতে শুরু করেন। তাঁর নানাও ছিলেন কুস্তিগির।
মাত্র দশ বছর বয়সে নজর কেড়েছিলেন গামা পালোয়ান। ১৮৮৮ সালে যোধপুরের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। চারশো’র বেশি কুস্তিগির অংশ নিয়েছিলেন সেখানে। প্রতিযোগিতায় বৈঠক (squat) সহ নানা কঠিন শরীরচর্চা অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও গামা শেষ ১৫ জনের মধ্যে নিজের জায়গা করে নেন। পরিণত কুস্তিগিরদের বিপক্ষে অসাধারণ প্রাণশক্তিতে ভরপুর দশ বছর বয়সী বালকের লড়াই করার দক্ষতা দেখে যোধপুরের মহারাজা যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। বয়স বিবেচনায় নিয়ে বালক গামা পালোয়ানকেই বিজয়ী ঘোষণা করেন তিনি। এরপর দাতিয়ার মহারাজার তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলনের সুযোগ পেয়ে যান গামা পালোয়ান।
খ্যাতির সূচনা
গামা পালোয়ানের খ্যাতির সূচনা ঘটে ১৭ বছর বয়সে, ১৮৯৫ সালে। তখন খ্যাতির শীর্ষে থাকা রহিম বখশ সুলতানিওয়ালাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন সদ্য তরুণ গামা পালোয়ান।
রহিম বখশ ছিলেন সে সময়ের রুস্তম-ই-হিন্দ বা উপমহাদেশের কুস্তি চ্যাম্পিয়ন। প্রায় সাত ফুট উচ্চতার এই কুস্তিগির সহজেই পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার গামাকে হারিয়ে দেবেন এমনটিই ধরে নেয়া হচ্ছিল। রহিম বখশও আরেক কাশ্মীরি পরিবার থেকে এসেছিলেন। তাঁর রেকর্ডের সামনে গামা পালোয়ান ছিলেন নেহায়েত শিশু। শুধু একটি দিকই গামা পালোয়ানের অনুকূলে ছিল, তা হচ্ছে বয়স। এটি ছিল রহিম বখশের ক্যারিয়ারের শেষ বেলা আর গামা পালোয়ান ছিলেন টগবগে তরুণ।
প্রথম পর্বে কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে লড়েন গামা। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। নাক ও কানে মারাত্মক রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও রহিম বখশকে বেশ ভালোভাবে ঘায়েল করতে সক্ষম হন। লড়াইটি অমিমাংসীতভাবে শেষ হয়। তখনই সবাই বুঝে গিয়েছিল ১৭ বছর বয়সী এই তরুণ পরবর্তী রুস্তম-ই-হিন্দ বা ব্রিটিশ ভারতের চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির হতে চলেছেন।
১৯১০ সালের মধ্যে রহিম বখশ ছাড়া উপমহাদেশের সব শীর্ষ কুস্তিগিরকে হারান গামা পালোয়ান। এরপর বিশ্বমঞ্চের দিকে নজর দেন তিনি, ছোট ভাই ইমাম বখশকে সাথে নিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান।
বিশ্বমঞ্চে লড়াই
খর্বাকৃতি তাঁর জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কোথাও লড়াইয়ের সুযোগ পাচ্ছিলেন না তিনি। সেজন্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, যেকোনো ওজন শ্রেণীর তিন জন কুস্তিগিরকে তিনি ৩০ মিনিটের মধ্যে হারিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু কেউ এটিকে গুরুত্বের সাথে নেয়নি।
এরপর গামা সে সময়ের বিখ্যাত কুস্তিগির স্ট্যানিসলাউস জিব্যাস্কো এবং ফ্যাঙ্ক গচ এর নাম উল্লেখ করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। তিনি বলেন হারলে প্রাইজ মানি ছাড়াও দেশে ফিরে যাওয়ার খরচ দেবেন। শেষ পর্যন্ত আরেক পেশাদার কুস্তিগির বেঞ্জামিন রোলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। গামা প্রথমবার ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ড এবং দ্বিতীয়বার ৯ মিনিট ১০ সেকেন্ডের মধ্যে তাকে ধরাশায়ী করেন। এ লড়াইয়ের পরদিন আরও ১২ জন কুস্তিগিরকে হারিয়েছিলেন তিনি আর এটিই তাঁকে ইউরোপের মাটিতে পেশাদার কুস্তি লড়ার সুযোগ করে দেয়।
১৯১০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর লন্ডনে জন বুল ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্ট্যানিসলাউস জিব্যাস্কোর সাথে লড়েন গামা। প্রায় তিন ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল সে লড়াই। জয় পরাজয়ের মীমাংসা করতে ১৭ সেপ্টেম্বর আবার লড়াই আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেদিন স্ট্যানিসলাউস জিব্যাস্কো অনুপস্থিত থাকায় গামা পালোয়ানকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই তাঁর ভক্তরা তাঁকে রুস্তম-ই-জামানা বলে ডাকতে শুরু করে। এরপর জাপান, রাশিয়া, ইউরোপ আমেরিকার বিখ্যাত কুস্তিগিরদের সাথে লড়াই জেতেন তিনি। গামার এই সাফল্যের পেছনে ছিল কঠোর শরীরচর্চা এবং উচ্চমাত্রার প্রোটিন ও ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খাবার গ্রহণ। মার্শাল আর্ট কিংবদন্তী ব্রুস লি গামার প্রশিক্ষণ পদ্ধতির একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন।
শেষ জীবন
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান এবং ভারতের জন্ম হলে পাকিস্তানে বসবাস করতে শুরু করেন গামা পালোয়ান। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় অংশে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান অংশেও দাঙ্গা দেখা দেয়। সেসময় বহু হিন্দুকে রক্ষায় ভূমিকা রাখেন গামা পালোয়ান। পাকিস্তান সরকার তাকে বসবাসের জন্য জমি দেয়। ১৯৬০ সালের ২৩ মে লাহোরে মারা যান তিনি।
আরও জীবনী: